সব মানুষ সমান নয়, অনেকে বিপদের প্রথম ধাক্কা খেয়েই অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়, সীট বেল্ট আটকানো থাকলে বাধা পাবে সে। কথা বলার মাঝখানে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিরতি নিচ্ছে ইনগ্রিড, কাঁটায় কাঁটায় ষাট সেকেন্ড পর আবার মুখ খুলল সে, প্রথমে আমার পরিচয়। অ্যাকশন কমান্ডো ফর হিউম্যান রাইটসের আমি একজন সিনিয়র অফিসার, সামান্য বাঁকা ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের ভাব নিয়ে থাকল ক্যাপটেন, প্লেনের বাইরে, চন্দ্রালোকিত মহাশূন্যের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
-এবং প্লেনটা এখন সম্পূর্ণ আমার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমার অফিসারদের অনুমতি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কেউ নিজের সীট ছেড়ে উঠবেন না। কেউ যদি এই নির্দেশ অমান্য করেন, হাই এক্সপ্লোসিভ দিয়ে গোটা প্লেন উড়িয়ে দেয়া হবে।
ঘোষণার পরপরই আবার সেটা সাবলীল জার্মান ভাষায় পুনরাবৃত্তি করা হলো। সবশেষে ফরাসি ভাষায়, তবে থেমে থেমে, বোঝা গেল মেয়েটা ভালো ফ্রেঞ্চ জানে না।
অ্যাকশন কমান্ডের অফিসাররা লাল শার্ট পরে থাকবে সহজেই যাতে আপনারা তাদের চিনতে পারেন।
ওদিকে ইনগ্রিড ঘোষণা শুরু করার পরপরই তার তিন সঙ্গী, ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের সামনের অংশে দাঁড়িয়ে যে যার ক্যানভাস ব্যাগের ফলস্ বটম্ খুলে ফেলেছে। ভেতরে জায়গা মাত্র দু-ইঞ্চি গভীর, চৌদ্দ ইঞ্চি লম্বা, আর আট ইঞ্চি চওড়া, তবে ভাঁজ করা বারে বোর পিস্তল আর দশ রাউন্ড কান্ট্রিজের জন্যে যথেষ্ট। পিস্তলগুলোর ব্যারেল চোদ্দ ইঞ্চি লম্বা, বোরগুলো মসৃণ, আর আরমার্ড প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। নিচে একটা বুলেটের প্যাসেজ হিসেবে এই প্লাস্টিক টেকার কথা নয়, তাই বিশেষ ধরনের বুলেট ব্যবহার করছে ওরা। এই বুলেটের ভেলোসিটি আর প্রেশার খুব কম। করডাইটের মাত্রাও অল্প, পরপর বেশ কয়েকটা গুলি করায় কোনো অসুবিধে নেই। ব্রীচ আর ডাবল পিস্তল গ্রিপও প্লাস্টিকের, সহজেই জায়গা মতো জোড়া লেগে গেল। গোটা আগ্নেয়াস্ত্রে ধাতব পদার্থ বলতে শুধু কেস স্টিল ফায়ারিং পিন আর প্রীং, ক্যানভাস ফ্লাইট ব্যাগের ধাতব পায়ার চেয়ে বড় নয় আকারে, কাজেই মাহে এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি চেকিঙের সময় মেটাল ডিটেকটরকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব হয়েছে। প্রতিটি ব্যাগে দশটা করে কাট্রিজ রয়েছে, প্লাস্টিক কেসে মোড়া–এগুলোরও শুধু পারকাশন ক্যাপ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে তৈরি, কোনো ইলেকট্রিক ফিল্ডকে উত্তেজিত করবে না। কার্ট্রিজগুলো লুপ করা বেল্টের ভেতর রয়েছে, বেল্টটা কোমরে জড়িয়ে দেয়া যাবে।
অস্ত্রগুলো ছোট, কালো আর কুৎসিত। সাধারণ শটগানের মতো করে লোড করতে হয়। ব্যবহৃত শেল নিজে থেকে ছিটকে পড়ে না, আর রিকয়েলের ধাক্কা এত প্রচণ্ড যে সবটুকু শক্তি দিয়ে পিস্তল গ্রিপ চেপে না ধরলে ব্যবহারকারীর কবজি নির্ঘাত ভেঙে যাবে। ত্রিশ ফিট দূর থেকে এর ধ্বংস-ক্ষমতা হতবাক করে দেয়। বারো ফিট দূর থেকে পেটে গুলি করলে নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসবে। আর ছয় ফিট দূর থেকে নিখুঁতভাবে আলাদা করে দিতে পারে মাথা। অথচ একটা ইন্টারকন্টিনেন্টাল এয়ারলাইনারের প্রেশার হাল (খোল) ফুটো করার ক্ষমতা নেই।
ওদের হাতের এই কাজটার জন্যে আদর্শ একটা অস্ত্র। সংযোজনের পর লোড করা হলো, টি-শার্টের ওপর লাল শার্ট গায়ে চড়াল পুরুষ দুজন, তারপর যে যার পজিশনে গিয়ে দাঁড়াল–একজন ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের পিছন দিকে, অপরজন টুরিস্ট কেবিনের পিছন দিকে। চেহারায় মারমুখো ভাব নিয়ে হাতের অস্ত্র তুলল তারা, সবাইকে দেখাল।
সুন্দরী, একহারা, কালো চুল মেয়েটা আরো কিছুক্ষণ বসে থাকল নিজের সীটে। অবশিষ্ট কোকো-ডি-মার থেকে গ্রেনেড বের করে নেটিং ব্যাগে ভরল সে, ইনগ্রিডের হাতে যেটা রয়েছে সেটার সাথে এগুলোর এক জায়গাতেই পার্থক্য-মাঝখানে জোড়া লাল রেখা। তার মানের এগুলোর ফিউজ ইলেকট্রনিক নিয়ন্ত্রিত।
কেবিন অ্যাড্রেস সিস্টেমে প্রাণবন্ত একটা কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে এই মুহূর্তে, আবার কথা বলছে ইনগ্রিড। ইতোমধ্যে আরোহীরা সবাই সম্পূর্ণ জেগে গেছে সার সার লম্বা সীটে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে প্রত্যেকে, চেহারায় হতচকিত বিপন্ন ভাব।
ও কে, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, অ্যাকশন কমান্ডোর একজন অফিসার কেবিনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হেঁটে আসছে, তাই না? ওর হাতে ওগুলো হাই এক্সপ্লোসিভ গ্রেনেড,-কালোকেশী জার্মান মেয়েটা প্যাসেজ ধরে হাঁটছে, পনেরোটা সীটের সারি পেরিয়ে একবার করে থামছে সে, ওভারহেড লকার খুলে ভেতরে একটা করে গ্রেনেড রাখছে, লকার বন্ধ করে আবার হাঁটছে। আরোহীদের মাথা একযোগে ঘুরতে শুরু করল, নিখাদ আতঙ্ক ভরা চোখে মেয়েটার কীর্তিকলাপ দেখছে তারা। গ্রেনেডগুলোর যে কোনো মাত্র একটারই প্লেনটাকে উড়িয়ে দেয়ার এক্সপ্লোসিভ পাওয়ার রয়েছে। একটা ব্যাটল ট্যাংকের গা তৈরি করা হয় ছয় ইঞ্চি মোটা ইস্পাত দিয়ে, অনেকেই জানেন আপনারা। এই গ্রেনেডের রয়েছে সেই ছয় ইঞ্চি মোটা ইস্পাতকে ভেঙে ভেতরের লোকগুলোকে মেরে ফেলার বিস্ফোরণ ক্ষমতা। আমার অফিসার প্লেনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত মোট চৌদ্দটা গ্রেনেড রাখছে। আমার নিয়ন্ত্রণে ইলেকট্রনিক ট্রান্সমিটার রয়েছে, গ্রেনেডগুলো একসাথে ফাটিয়ে দেয়া যাবে। এরপর তার কণ্ঠস্বরে কিছুটা দুষ্টামির সুর পাওয়া গেল, সেই সাথে মৃদু হাসির আওয়াজ। আর যদি ফাটে, নর্থ পোল থেকেও শোনা যাবে আওয়াজটা।