প্রথম দশজনের সাথেই জাম্প করে পিটার। পাঁচশো ফিট ওপর থেকে লাফ দেয়, হ্যাচকা টানের সাথে প্যারাসুট খোলে যেন মাটি স্পর্শ করার কয়েক সেকেন্ড আগে। তবে বিভিন্নমুখী জোরাল বাতাস থাকায় এত অল্প উঁচু থেকে লাফ দিলেও পরস্পরের কাছ থেকে বেশ একটু ছড়িয়ে পড়ে ওরা। আজকের প্রথম ল্যান্ডিংটা টার্গেট এরিয়ার যথেষ্ট কাছাকাছি না হওয়ায় অসন্তুষ্ট হলো পিটার। জাম্প করার পর থেকে পরিত্যক্ত অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিংয়ে পেনিট্রেট করতে সময় লাগল দুমিনিট আটান্ন সেকেন্ড।
নির্জন স্যালিসবারি প্রান্তর, মিলিটারি জোন।
এখানে যদি আতঙ্কবাদীরা একদল লোককে জিম্মি করে রাখত, যে-সময়ে পৌঁছেছি তাতে বড়জোর মেঝে থেকে রক্ত মোছর সময় পেতাম। আবার আমরা প্র্যাকটিস করব!
দ্বিতীয়বার ওরা এক মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ডের মাথায় ঢুকল বিল্ডিংয়ে, ঝকের প্রতিটি লোক আড়াল নিয়ে তৈরি হতে আরও দশ সেকেন্ড সময় নিল। কলিন নোবলসের দু-নম্বর স্ট্রাইকার টীমের চেয়ে পঁচিশ সেকেন্ড এগিয়ে থাকল ওরা।
এরপর, সেলিব্রেট করার জন্যে দৌড়ে এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছুল ওরা, প্রত্যেকে পুরোদস্তুর কমব্যাট কিট পরে আছে, ব্যবহার করা প্যারাস্যুট সিল্কের মস্ত বান্ডিলটাও বয়ে নিয়ে আসতে হলো।
হারকিউলিস বিমান ওদের পুরো দলটাকে হেডকোয়ার্টারে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে আসতে অন্ধকার ঘনিয়ে গেল।
কলিন নোবলসের কাছে ডি-ব্রিফিংয়ের থেকে পালাতে পারলে বাঁচে পিটার।
তার ধারণা, মেলিসা জেইন নিশ্চয়ই ইস্ট ক্রয়ডন স্টেশনে পৌঁছে গেছে এতক্ষণে। গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে পিটার, দশ মিনিটের মধ্যে ওকে নিয়ে নতুন ভাড়া করা কটেজে পৌঁছে যাবে ড্রাইভার। কটেজে একা একা অপেক্ষা করার সময় ওর ওপর রেগে যাবে মেলিসা। বেসের গেট থেকে কটেজটা মাত্র অর্ধেক মাইল দুরুত্বে।
থোর কমান্ডের নেতৃত্ব নেয়ার পর থেকে, আজ ছয় সপ্তাহ, একদিনের জন্যেও ছুটি নেয়নি পিটার। অপরাধবোধের দংশন অনুভব করল ও, এমনটা আসলে করা উচিত হয় নি। দ্রুত, আজকের মতন কলিন নোবলের কাছে দায়িত্বভার হস্তান্তর করল।
উইকএন্ডে কোথায় যাচ্ছো হে? কলিন জানতে চাইল।
আগামীকাল রাতে একটা পপ গানের কনসার্টে নিয়ে যাচ্ছে মেলিসা আমাকে, মুচকি হাসে পিটার, কি যে গান শুনব—-ভালোই জানা আছে।
ঠিক আছে, মেলিসাকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে, কলিন বিদায় দেয়।
নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে পিটার সাধারণত মুখ খোলে না অতটা। জীবনের বেশিরভাগ সময় মেসে না হয় ব্যারাকে কাটিয়ে এই গোপনীয়তা এখন উপভোগ করছে সে।
কম্পাউন্ড থেকে গাড়িতে মাত্র সাড়ে চার মিনিটের পথ হলেও নির্জন প্রান্তরে নিঃসঙ্গ একটা দ্বীপের মতো কটেজটা। ফার্নিশ বাড়ির এত কম ভাড়া- ভাবাই যায় না। উঁচু একটা মাটির পাহাড়ের পিছনে অযত্নে বেড়ে ওঠা বাগানের মাঝখানে তিন কামরার সাজানো-গোছানো শান্তি নীড়। গত ক-সপ্তা থেকে এটাই ওর বাড়ি। এখনো পর্যন্ত নিজের বইপত্রগুলো গোছগাছ করতে পারেনি পিটার। প্রায় বিশ বছরের সংগ্রহ- সাজিয়ে রাখা সহজ নয়। অবশ্য, নতুন এই চাকরিতে পড়াশোনা করার সুযোগ বলতে গেলে হয় না তার।
মেলিসা নির্ঘাত খোয়া বিছানো পথে ওর গাড়ির চাকার শব্দ পেয়েছিল, অপেক্ষায় থেকে বোধ হয় বোর হয়ে গেছে মেয়েটা। দৌড়ে, সদর দরজা ঠেলে ড্রাইভওয়েতে বেরিয়ে এল সে। সরাসরি পিটারের গাড়ির হেডলাইটের সামনে। ওর কমনীয় মুখটা দেখে বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল পিটারের।
গাড়ি থেকে ও নামতে যত দেরি, ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই হাতে ওকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ওকে ধরে রাখল পিটার, কেউ কোনো কথা বলছে না। জীবনীশক্তিতে ভরপুর, ওর আলিঙ্গনের ভিতর এক তরতাজা প্রাণ মেলিসা।
অবশেষে, চিবুক উঁচু করে ধরে তার মুখটা ভালো করে পরখ করে দেখল পিটার। বিশাল বড় বেগুনি চোখদুটোতে জল; নাক টানছে বেচারি। দাগহীন মুখটা অদ্ভুত মিষ্টি।
যত্ন করে কপালে চুমো খেল পিটার।
ওহ, ড্যাডি, তুমি এমন কেন? চোখে পানি নিয়েও পায়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে বাপের গালে চুমো খেল মেলিসা।
ক্রয়ডনের একটা ইতালিয় রেস্তোরাঁয় খাবার খেল ওরা দুজন। সারাক্ষণ বকবক করে গেল মেলিসা, চুপচাপ শুনল কেবল পিটার। বিশ্বাস করা কঠিন- ওর বয়স এখনো চোদ্দ পেরোয়নি। গায়ে-গতরে এখনই পূর্ণবয়স্কা হয়ে উঠেছে মেলিসা।
কটেজে ফিরে, ওদের দুজনের জন্যে ওভালটিন বানাল মেয়েটা; উইকএন্ডে কি কি করবে তাই নিয়ে দারুণ উত্তেজিত সে। মার কথা সচেতনভাবেই উচ্চারণ করল না দুজনের একজনও।
শোবার সময় হতে, বাপের কোলে মাথা রেখে মুখে আঙুল বোলাতে লাগল মেলিসা।
তুমি জানো, তোমাকে দেখে আমার কার কথা মনে পড়ে?
কার কথা? পিটার উৎসাহ দেয় মেয়েকে।
গ্যারি কুপার অবশ্য অনেক কম বয়স্ক সময়ের। দ্রুত যোগ করে মেলিসা।
বুঝলাম। কিন্তু গ্যারি কুপারের কথা তুমি শুনলে কোথায়?
ওই যে- গত শনিবারে টেলিভিশনে একটা মুভি দেখে!
নিচু হয়ে মেয়ের ঠোঁটে চুমা খেতে চিনি আর ওভালটিনের স্বাদ পেল পিটার; মিষ্টি সুবাস তার চুলে।
তোমার বয়স কত, ড্যাডি?
ঊনচল্লিশ।
ওহ, ওটা খুব বেশি বয়স নয়। একটু যেন স্বস্তি মেলিসার গলায়।
কখনো ডাইনোসরদের কথা ভেবে দেখেছ- ঠিক ওই মুহূর্তে বেজে ওঠে কাপের পাশে রাখা খুদে এলার্ম। পেটে কিসের যেন একটা টান অনুভব করে পিটার।