তারপর আরেক হাতে গ্যাস মাস্কটা মুখ থেকে নামাল ও। আর কেউ নেই। অপারেশন কমপ্লিট! চেঁচিয়ে বলল পিটার। মাইক্রোফোনের সুইচ অন করল ও। টাচ ডাউন! টাচ ডাউন! পরিপূর্ণ সাফল্যের কোড সিগনাল। থোর কমান্ডের তিনজন কমান্ডো ধরে রেখেছে ইনগ্রিডকে, আহত হয়েও কার্পেটের ওপর নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টায় ধস্তাধস্তি করছে সে খাঁচায় বন্দী হিংস্র নেকড়ের মতো।
ইমার্জেন্সী প্লাস্টিক স্লাইড নামাও, নির্দেশ দিল পিটার, প্রতিটি খোলা প্রবেশপথ থেকে বাতাস ভরা লম্বা প্লাস্টিক স্লাইড নেমে গেল টারমাকে। থোর কমান্ডোর লোকেরা সাথে সাথে আরোহীদের পথ দেখিয়ে নামতে নিয়ে চলল।
ওঁয়া ওঁয়া করতে করতে বারোটা অ্যাম্বুলেন্স ছুটে এল টার্মিনাল ভবন থেকে। থোর কমান্ডের ব্যাক-আপ টিম সদ্য জ্বলে ওঠা ফ্লাডলাইটের আলোয় ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে ছুটে আসছে বোয়িংয়ের দিকে। উল্লাসে ফেটে পড়ছে তাদের গলা, টাচ ডাউন! টাচ ডাউন!
প্রাগৈতিহাসিক দানবের মতো উত্তরপ্রান্তের অ্যাপ্রন থেকে ছুটে এল প্রকাণ্ড যান্ত্রিক সিঁড়ি।
এক হাতে ক্যামেরা নিয়ে মেয়েটার দিকে ঝুঁকল পিটার। হাত-পা ছোঁড়া বন্ধ করে পিটারের দিকে তাকাল ইনগ্রিড। তার চোখ দুটো অঙ্গারের মতো জ্বলছে। কপালে ঘাম, হাঁপাচ্ছে সে। হঠাৎ মাথাটা একটু পিছিয়ে নিল, ছোবল মারার আগে সাপ যেমন পিছিয়ে নেয়। একদলা থুথু ছুঁড়ে দিল সে। পিটারের পায়ের ওপর ছড়িয়ে পড়ল সাদা ফেনা। পিটারের পাশে এসে দাঁড়াল কলিন। দুঃখিত, স্যার। চেয়েছিলাম, কিন্তু হার্টে লাগেনি।
আমাকে তোমরা আটকে রাখতে পারবে না, আচমকা চিৎকার জুড়ে দিল ইনগ্রিড়। তোমাদের মতো চুনোপুঁটির কাজ নয় আমাকে আটকে রাখে। বড়জোর দুমাস, হাসতে হাসতে বেরিয়ে যাব আমি!
আমার লোকেরা আমাকে ছিনিয়ে নিতে আসবে! আবার থুথু ছুঁড়ল মেয়েটা, এবার তাকে যারা ধরে রেখেছে তাদের একজনের মুখে।
হয় ছিনিয়ে নেবে না হয় বাধ্য করবে আমাকে ছেড়ে দিতে…।
সত্যি! দুনিয়া জুড়ে অদ্ভুত এক অরাজকতা চলছে। বন্দী হাইজ্যাকার বা সন্ত্রাসবাদীদের মুক্ত করার জন্যে তাদের দলের সশস্ত্র লোকেরা জঙ্গী মিছিল করবে, রাস্তা-ঘাটে ভিড়ের মধ্যে বোমা ফাটাবে, নিরীহ শিশু আর মহিলাদের অপহরণ করে আটকে রাখবে। পিটারের মনে হলো, আজকের ওর এই সাফল্য আসলে সাময়িক একটা ব্যাপার মাত্র। অশুভ শক্তির গতি মন্থর করতে পেরেছে হয়তো, কিন্তু তাদের পরাজিত করতে পারেনি। আরো শক্তি সঞ্চয় করে, আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে আবার ওরা ছোবল মারবে। কে জানে, এই মেয়েটাই হয়তো নেতৃত্ব দেবে তখনো।
আমরাই বিপ্লব! অক্ষত হাতটা কপালের কাছে তুলে স্যালুট করার ভঙ্গি করল ইনগ্রিড। আমরাই শক্তি। কেউ, দুনিয়ার কোনো শক্তি আমাদের রুখতে পারবে না।
পিটারের চোখের সামনে অন্তঃসত্ত্বা মহিলার বিকৃত লাশটা ভেসে উঠল। পাকা ফলের মতো ফেটে গিয়েছিল তার ফোলা পেট।
ওর মুখের সামনে শক্ত মুঠো করা হাতটা নাড়ল ইনগ্রিড। এই তো সবে শুরু–শুভ সূচনা ঘটেছে নতুন যুগের…।
সিধে হলো পিটার। অস্থির বোধ করছে ও।
তোমরা জিততে পারবে না! বিজয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী… তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচায় ইনগ্রিড।
.
সুধীবৃন্দ, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাইম মিনিস্টার বিচিত্তে ধীরে ধীরে কথা বলছেন, তার চেহারায় গাম্ভীর্য মেশানো অভিমান, কণ্ঠস্বরে পরাজয়ের সুর, আমি এবং আমার কেবিনেট দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে টেরোরিস্টদের দাবি মেনে নেয়ার অর্থ হচ্ছে হিংস্র একটা বাঘের পিঠে আশ্রয় নেয়া, যার পিঠ থেকে আর কখনোই আমরা নামতে পারব না। থেমে টেবিলের অপরপ্রান্তে পাশাপাশি বসা অ্যামবাসডরদের দিকে তাকালেন, তার কাঁধ ঝুলে পড়ল। কিন্তু মানবতার স্বার্থে অনেক সময় চরম ত্যাগ স্বীকার না করে উপায় থাকে না। তাছাড়া, বৃহৎ একাধিক দেশের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা ছোট একটা দেশের না থাকারই কথা। এই সব বাস্তবতা উপলব্ধি করে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে টেরোরিস্টদের দাবিগুলো মনে নিয়ে অন্তত শিশু আর মহিলাদের উদ্ধার করা যেতে পারে…
মার্কিন অ্যামব্যাসাডরের সামনে ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল টেলিফোন। ভ্র কুঁচকে উঠল প্রাইম মিনিস্টারের, কিন্তু আবার তিনি শুরু করলেন, তবে দুনিয়ার অন্যতম মাতবর হিসেবে আপনাদের সরকারদ্বয় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আমি আশা করি…. ফোনের বেল আবার বাজতে শুরু করায় তিনি অসহায় একটা ভাব করে থেমে গেলেন। তারপর বললেন, আপনি বরং কথা বলে নিন, স্যার…।
এক্সকিউজ মি, মি, প্রাইম মিনিস্টার, কেনি কনস্টেবল ফোনের রিসিভার তুললেন। ধীরে ধীরে তার চেহারায় বিস্ময় আর অবিশ্বাস ফুটে উঠল। এক মিনিট ধরুন, বলে প্রাইম মিনিস্টারের দিকে তাকালেন তিনি, হাত দিয়ে মাউথপীসটা চাপা দিলেন। মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমি অতীব আনন্দের সাথে আপনাকে জানাচ্ছি যে তিন মিনিট আগে থোর কমান্ডের অ্যাসল্ট টীম কমান্ডো হামলা চালিয়ে বোয়িং জিরো-সেভেন-জিরো দখল করে নিয়েছে। তিনজন টেরোরিস্ট মারা গেছে, গুরুতরভাবে আহত অবস্থায় ধরা পড়েছে আরেকজন, কিন্তু আরোহীদের একজনও হতাহত হয়নি। ইতোমধ্যে তাদের সবাইকে প্লেন থেকে বের করা হয়েছে। সবাই সুস্থ এবং অক্ষত।