মনে মনে একটা হিসেব করল পিটার, গো থেকে এখানে আসতে ছয় সেকেন্ড লেগেছে, মহড়ায় এর চেয়ে বেশি লেগেছিল। বিপদ আর ঝুঁকির মধ্যে মানুষের ক্ষিপ্রতা অনেক বেড়ে যায়।
পিটার আর ওর দুনম্বর সমস্ত শক্তি এক করে ইমার্জেন্সী এস্কেপ হ্যাচের রিলিজে চাপ দিল, স্থানচ্যুত হয়ে ভেতর দিকে ছিটকে পড়ল সেটা। গ্রেনেড হাতে অপেক্ষা করছিল অন্য দুজন কমান্ডো, বিদ্যুৎ খেলে গেল তাদের শরীরে। তারপর চারজনই ওরা সেজদার ভঙ্গিতে বসে পড়ে যে যার চোখ আর কান ঢাকল।
কেবিনের বাইরে রয়েছে ওরা, তবু মনে হলো গজব পড়েছে মাথায়। বিস্ফোরণের শব্দের সাথে তীব্র আলোর ঝলকানি, বন্ধ চোখ হাত দিয়ে ঢাকা থাকা সত্ত্বেও এক্স-রে ছবির মতো লালচে আঙুলগুলো দেখতে পেল পিটার। পরমুহূর্তে গ্রেনেড টিমের লোকেরা কেবিনের দিকে মুখ করে গর্জে উঠল, শুয়ে পড়ুন! সবাই শুয়ে পড়ুন। এখন থেকে ওরা বিরতিহীন চিৎকার করতে থাকবে, যতক্ষণ প্রয়োজন মনে করে।
বিস্ফোরণের ধাক্কা খেয়ে গতি কমে গেল পিটারের, ওয়ালথারের বটে একবার পিছলে গেল হাত, ঝটকা মেরে হ্যাঁমার টেনে ভেতরে ঢুকলও। খোলা হ্যাচ দিয়ে প্রথমে ভেতরে ঢুকল জোড়া পা, যেন একজন দৌড়বিদ সর্বশেষ রেখা স্পর্শ করার জন্যে শরীরটাকে পিছলে দিয়েছে। শূন্যে থাকতেই ক্যামেরা হাতে লাল শার্ট পরা মেয়েটাকে ছুটে আসতে দেখল ও, কি যেন চিৎকার করে বলছে। ডেকে পা ঠেকতেই গুলি করেছে ও, গুলিটা তার মুখে লাগল। সাদা দুসারি দাঁতের মাঝখানে লাল একটা গর্ত তৈরি করল বুলেট, মাথাটা পিছন দিকে এত জোরে ঝাঁকি খেল যে ঘাড়ের ভঙ্গুর হাড়টা ভেঙে গেল, আওয়াজটা পরিষ্কার শুনতে পেল পিটার।
.
দুহাত দিয়ে কান আর চোখ ঢেকে রেখেছে ইনগ্রিড, ঝুঁকে আছে সামনের দিকে। লোক ঠাসা কেবিনের ভেতর আগুন আর আলোর তাণ্ডব বয়ে গেছে। তারপরও ধাক্কাটা সামলাবার জন্যে একটা সীটের পিঠ ধরে টলতে লাগল সে, হিসেব করার চেষ্টা করছে থোর কমান্ডের লোকেরা খোলর ভেতর কখন ঢুকবে।
খোলের বাইরে যারা থাকবে বিস্ফোরণে তাদের খুব একটা ক্ষতি হবে না, প্রাণে বেঁচে যাবে। ইনগ্রিড চাইছে গোটা অ্যাসল্ট টিম ভেতরে ঢুকলে গ্রেনেডগুলো ফাটাবে সে। যত বেশি সম্ভব লোককে নিজের সাথে নিয়ে যেতে চায়। ক্যামেরাটা দুহাতে ধরে হাত দুটো মাথার ওপর তুলল, অপেক্ষা করছে। এসো, চলে এসো!
গোটা কেবিন ধোয়ায় ভরে গেছে, বারুদের গন্ধে বন্ধ হয়ে আসছে দম। প্যানেল থেকে ঝুলে থাকা হোসগুলো দুলছে আর মোচড় খাচ্ছে। একটা শট পিস্তলের গুলি হলো, কেউ চিৎকার করে বলল, শুয়ে পড়ুন! সবাই শুয়ে পড়ুন! খোলা ইমার্জেন্সী হ্যাচওয়ের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ইনগ্রিড, ডিটোনেটর বোতামে আঙুল। কোথা থেকে আচমকা কালো একটা মূর্তি ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার ওপর।
না, তুমি খুন করতে পারো না! এভাবে আমরা মরব না! ইনগ্রিডের উঁচু করা হাত ক্যারেনকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হলো, কিন্তু মুঠোর মধ্যে ক্যামেরার স্ট্র্যাপটা পেয়ে হ্যাচকা টান দিল ক্যারেন। মেরো না, আমাদের মেরো না! খলিফা আমাদের ছাড়াবে, খলিফা বলেছে আমরা কেউ খুন হব না! ক্যামেরা নিয়ে সামনের দিকে ছুটল সে, হিতাহিত জ্ঞান নেই। খলিফা…
খোলা হ্যাচ দিয়ে উড়ে এল পিটার, প্যাসেজের মাঝখানে পা দিয়েই গুলি করল। পরের গুলি দুটো এত দ্রুত বেরুল শব্দ শুনে মনে হলো একটাই গুলি হয়েছে, পেটে আর বুকের ভেতর বিস্ফোরিত হলেও শিরদাঁড়া আর শোল্ডার ব্লেড চুরমার করে দিল ক্যারেনের। ঝাঁকি লেগে তার হাত থেকে ছুটে গেল ক্যামেরাটা, ডিগবাজি খেতে খেতে অচেতন একজন আরোহীর কোলে পড়ল।
বুনো বিড়ালের মতো সাথে সাথে লাফ দিল ইনগ্রিড, প্যাসেজে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করল। ধোঁয়ায় কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু এভাবে এগোলে দেরি হয়ে যাবে। আরো বিশ ফিট দূরে রয়েছে ওটা। দাঁড়াতে হবে তাকে, চারটে অচেতন দেহ টপকে ক্যামেরার কাছে পৌঁছুতে হবে।
.
তিনটে গুলি করে নাচের ভঙ্গিতে জায়গা বদল করল পিটার, দুনম্বরের জন্যে ঠাই করে দিল। ঠিক পিটারের ফেলে আসা জায়গাতেই জোড়া পা দিয়ে নামল দুনম্বর, পিছনের গ্যালির আড়াল থেকে বেরিয়েই তাকে গুলি করল লাল শার্ট পরা কার্ট। ভারী বুলেটের ধাক্কায় পিটারের পায়ের কাছে আছাড় খেল দুনম্বর, ভাজ করা ছুরির মতো বাঁকা হয়ে গেছে শরীর, শরীরে প্রাণ নেই।
গুলির আওয়াজের দিকে পাঁই করে ঘুরল পিটার, ধোয়ার ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসা ইনগ্রিডের দিকে পিছন ফিরল। গুলি করার পর পিস্তলের ব্যারেল সিলিঙের দিকে উঠে গেছে, প্রাণপণ চেষ্টায় সেটাকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছে কার্ট। তার লাল নাভি পর্যন্ত খোলা, শক্ত আর চকচকে পেশি কালো লোমে ঢাকা, ঝাঁকড়া চুল ভর্তি মাথার নিচে চোখ দুটো একজন উন্মত্ত খুনির। পিটারের গুলি তার লোমশ বুকে আঘাত করল, দ্বিতীয়টা চুরমার করে দিল কপালের হাড়। শক্তি মদমত্ত লোকটা এক নিমেষে রক্তাক্ত কাদার মতো হয়ে গেল, প্যাসেজে মুখ থুবড়ে পড়ে আর নড়ল না।
দুজন, বিড়বিড় করে বলল পিটার। সম্পূর্ণ শান্ত রয়েছে ও, দক্ষতার সাথে হাতের কাজ করে যাচ্ছে। হিসেবেও ভুল নেই, ওয়ালথারে এখনো চারটে বুলেট রয়েছে। আরো দুজন আছে। কিন্তু ধোয়ার জন্যে পনেরো ফিটের ওদিকে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া দুলতে থাকা অক্সিজেন হোসগুলোও চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিচ্ছে।