প্রবল বেগে মাথা নাড়ল ক্যারেন। খলিফার কখনো ভুল হয় না। এখনো এক ঘণ্টা বাকি রয়েছে ডেডলাইনের।
এই সময় একবার কেঁপে উঠে নিভে গেল আলো। পোর্ট হোলে শেড থাকায় বোয়িংয়ের ভেতরটা গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল, এয়ার-কন্ডিশনিংয়ের হিসহিস থেমে যাওয়ায় নেমে এল জমাট নিস্তব্ধতা।
অন্ধকারে বিস্ময়সূচক কিছু আওয়াজ হলো।
কন্ট্রোল প্যানেল হাতড়াল ইনগ্রিড। বোতামটা পেয়ে চাপ দিল সে, প্লেনের নিজস্ব ব্যাটারিচালিত আলো জ্বলে উঠল-মান আর নিস্তেজ। নরম আলোর আভায় ইনগ্রিডকে উত্তেজিত দেখল ক্যারেন।
পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছে ওরা, হিসহিস করে বলল ইনগ্রিড। এয়ার-কন্ডিশনিং…হয়তো ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণা করা হয়েছে।
না, প্রায় চিৎকার করে বলল ক্যারেন। ফ্লেয়ার কোথায়?
কিন্তু…, মুখের ভেতর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে ইনগ্রিডের, জিভটাকে অনেক বড় লাগছে। ক্যারেনের চেহারা তার চোখে ঝাপসা লাগল, মুখের কিনারাগুলো পরিষ্কার নয়। ক্যারেন,–শুরু করল আবার, কিন্তু নাকে কি যেন একটা গন্ধ পেয়ে ছ্যাৎ করে উঠল তার বুক। হঠাৎ বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ জোড়া। গড, ওহ্ গড! আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল তার গলা থেকে, ম্যানুয়েল অক্সিজেন রিলিজ করার জন্যে উন্মাদিনীর মতো লাফ দিল সামনের দিকে। প্রতিটি সীটের ওপরের প্যানেলে কোরাগেটেড হোস সহ অক্সিজেন মাস্ক রয়েছে।
কার্ট! হেনরি! কেবিন ইন্টারকমের মাউথপীসে মুখ ঠেকিয়ে সে, ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করে শ্বাস টানতে লাগল। ফার্স্ট ক্লাস গ্যালিতে ক্রুদের একজন নিঃশব্দে ঢলে পড়ল সামনের দিকে। আরেকজন ঘুমিয়ে পড়ল কাত হয়ে।
ঘনঘন অক্সিজেন টানতে টানতে গলা থেকে ক্যামেরাটা নামাল ইনগ্রিড, আতঙ্ক ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ক্যারেন।
তু-তুমি কি স-ব উড়িয়ে দিতে চা-চাও, ইনগ্রিড? অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ক্যারেন, মনে হলো কেঁদে ফেলবে, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ছে। না, প্লিজ, না!
তাকে গ্রাহ্য না করে মাইক্রোফোনে চিৎকার করছে ইনগ্রিড, কার্ট! হেনরি! পাওয়ার সাপ্লাই আবার শুরু হবার সাথে সাথে চলে আসবে শক্ররা। চোখ আর কান ঢাকো, স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করবে ওরা। ডানার দিকে জানালা আর দরজায় নজর রাখো। আবার অক্সিজেন মাস্ক পরে হাপরের মতো হাপাতে লাগল সে।
মে-মেরো না, ইনগ্রিড! আবার মাস্ক খুলে ফেলেছে ক্যারেন। সারেন্ডার করলে খ-খলিফা আমাদের এ-এক মাসের এক মধ্যে ছা-ছাড়িয়ে আনবে! আমাদের ম-মরার কোনো দু-দরকার নেই! সে ঠিক তোতলাচ্ছে না, কথা আটকে যাচ্ছে মুখে। হঠাৎই আবার চোখ ধাঁধিয়ে ফিরে এল আলো, মৃদু হিস-হিস আওয়াজের সাথে চালু হয়ে গেল এয়ার-কন্ডিশনিং।
বুক ভরে অক্সিজেন নিয়ে ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের দিকে ছুটল ইনগ্রিড, কয়েকজন জিম্মি আর দুজন এয়ার হোস্টেসের অজ্ঞান দেহ লাফ দিয়ে টপকাল, ঝুলন্ত আরেকটা অক্সিজেন মাস্ক খপ করে মুখে পরে গোটা কেবিনের ওপর চোখ বুলাল। কার্ট আর হেনরি ছাদের কাছাকাছি প্যানেল থেকে নেমে আসা অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করছে। পোর্ট উইং প্যানেলের কাছে অস্ত্র হাতে তৈরি হয়ে আছে কার্ট, আর হেনরি দাঁড়িয়েছে পিছনের হ্যাচের পাশে, তার হাতেও পিস্তল। কিন্তু মাস্কে ঢাকা বলে তাদের মুখ দেখতে পেল না ইনগ্রিড।
অল্প কয়েকজন আরোহী বুদ্ধি করে তাড়াতাড়ি অক্সিজেন মাস্ক টেনে নিয়ে মুখে লাগিয়েছিল, শুধু তারাই জ্ঞান হারায়নি। বাকি সবাই হয়তো সীটের ওপর ঢলে পড়েছে নয়তো কাত হয়ে পড়ে গেছে সীট থেকে।
খালি হাতে ক্যামেরা ধরে আছে ইনগ্রিড। এখনো অক্সিজেন নিচ্ছে সে। জানে এয়ার-কন্ডিশনিং চালু হলেও গ্যাস বেরিয়ে যেতে আরো অনেক সময় লাগবে। যা ঘটার দু-এক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটবে, তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে সে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ক্যারেন, মাস্কের ভেতর ঠোঁট নড়ছে তার, আপন মনে বিড়বিড় করে কি বলছে, শোনা যাচ্ছে না।
সঙের মতো দাঁড়িয়ে থেকো না, ধমকের সুরে বলল ইনগ্রিড। ফ্রন্ট হ্যাচটা কাভার কর, যাও।
ইনগ্রিড, আ-আমাদের মরার কোনো দরকার নেই… আবেদন জানাল ক্যারেন, এবং সাথে সাথে ভেঙে পড়ার শব্দ নিয়ে ভেতর দিকে বিস্ফোরিত হলো পোর্ট উইঙের ইমর্জেন্সী এগজিট প্যানেল। সদ্য তৈরি কালো গহ্বর থেকে আরো কালো একজোড়া গোল বস্তু উড়ে এল কেবিনের ভেতর।
স্টান গ্রেনেড! আর্তনাদ করে উঠল ইনগ্রিড। গেট ডাউন!
.
নীলিমায় ডানা মেলে দেয়া বাজপাখির মতো হালকা আর স্বচ্ছন্দ বোধ করল পিটার। শরীরে এমন একটা সর্বগ্রাসী ক্ষিপ্র ভাব এসে গেছে যে মনে হলো বেয়ে নয়, উড়ে এল ও-হাত আর পা যেন মইয়ের ধাপগুলো স্পর্শই করেনি। ছুঁড়ে দেয়া ঢিলের মতো লাগছে নিজেকে, মনে এখন আর কোনো রকম দ্বিধা নেই, জাতশত্রু টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছে বলে পরম স্বস্তি বোধ করছে। সারা জীবনের ট্রেনিং আর নীতিবোধ আজকের বিশেষ মুহূর্তটিতে আগুন ধরা বারুদের মতো করে তুলেছে ওকে।
মইয়ের শেষ ধাপ থেকে লাফ দিল পিটার, মসৃণ আর বাকনো ডানার কিনারা টপকে সারফেসের ওপর কাঁধ আর নিতম্ব দিয়ে পড়ল, উঠে দাঁড়াল একপলকে, চওড়া আর চকচকে ধাতব মেঝে পেরোল নিঃশব্দ পায়ে। ওর পায়ের চারপাশে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মুক্তো দানার মতো ফেটে পড়ছে, ছোটার সময় ভেজা বাতাসে চুল উড়ছে ওর। মেইন খোলের সামনে পৌঁছুল ও, প্যানেলের একপাশে হাঁটু গেড়ে পজিশন নিল, কিলবিল করতে করতে আঙুলগুলো খুঁজে নিল জয়েন্টের সূক্ষ্ম রেখাটা। উল্টো দিক ঝট করে নিচু হলো ওর টিমের দুনম্বর লোকটা।