সাবধানে ফিউজটা সরাল ইঞ্জিনিয়ার, সামান্য একটু শিথিল হলো মেয়েটার কাঁধের পেশি।
আবার নির্দেশ দিল সে, ডিপারচার ক্লিয়ারান্স পড়ে শোনাও।
রাডারের আওতা থেকে বেরিয়ে নাইরোবি যাবার অনুমতি পেয়েছি আমরা। ঊনচল্লিশ হাজার ফিট পর্যন্ত উঠতে পারব।
তোমার পরবর্তী অপারেশনস নরম্যাল-এর সময় বল। অপারেশনস নরম্যাল হলো রুটিন রিপোর্ট, নাইরোবি কন্ট্রোলকে জানাতে হবে প্ল্যান অনুসারেই এগোচ্ছে ফ্লাইট।
এগারো মিনিট পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড পর। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের বয়স বেশি হলে পঁয়ত্রিশ হবে, তার মাথাতেও সোনালি চুল। কপালটা চওড়া, এখন সেখানে ঘাম চিকচিক করছে। সপ্রতিভ চেহারা, বিপদের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ট্রেনিংও নেয়া আছে তার।
ক্যাপটেনের দিকে মুখ ফেরাল স্বর্ণকেশী, পরস্পরকে বোঝার চেষ্টায় দুজনের দৃষ্টি অনেকক্ষণ এক হয়ে থাকল। ক্যাপটেনের মাথায় কালোর চেয়ে সাদা চুলই বেশি, বড়সড় গোল খুলি কামড়ে রয়েছে। ষাড়ের মতো চওড়া ঘাড়, আর মাংসল মুখ দেখে তাকে কসাই বা চাষী বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক-কিন্তু তার চোখ জোড়া স্থির, আচরণ শান্ত এবং দৃঢ়। এই লোককে চোখে চোখে রাখতে হবে, সাথে সাথে উপলব্ধি করল মেয়েটা।
আমি চাই কথাগুলো আপনি বিশ্বাস করুন। মৃত্যু আমার কাছ থেকে ক ইঞ্চি দূরে, আমি জানি। আমার একটা আদর্শ আছে, আদর্শের জন্যে নিজের জীবন দিতে পারলে আমি ধন্য হব। মেয়েটার গভীর নীল চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। ক্যাপটেনের বাদামী চোখ স্থির হয়ে আছে, সেখানেও ভয়ের কোনো ছাপ নেই, আছে সমীহের ক্ষীণ একটু আভাস। মনে মনে খুশি হলো মেয়েটা, ক্যাপটেন তাকে হালকাভাবে নিচ্ছে না। তার সতর্ক হিসেবে এই সমীহের ভাবটা আদায় করা গুরুত্বপূর্ণ, জরুরি ছিল।
আমি আমার অস্তিত্ব এই অপারেশনে উৎসর্গ করেছি।
আমি বিশ্বাস করি, বলে একবার মাথা ঝাঁকাল পাইলট।
চারশ সতেরোটা প্রাণ, সবার দায়িত্ব আপনার কাঁধে, বলে চলেছে মেয়েটা। শুধু যদি আপনি আমার প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন, ওরা সবাই নিরাপদে থাকবে। এই একটা কথা আপনাকে আমি দিতে পারি।
বেশ।
এই নিন আমাদের নতুন গন্তব্য। ছোট একটা টাইপ করা কার্ড দিল মেয়েটা। নতুন একটা কোর্স চাই আমি, বাতাসের মতিগতি আর পৌঁছুবার সময় সহ। পরবর্তী অপারেশনস নরম্যাল রিপোর্ট পাঠাবার পরপরই নতুন কোর্স ধরবেন-, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকাল সে, সময় জানতে চায়।
নয় মিনিট আটান্ন সেকেন্ড, সাথে সাথে জানাল ইঞ্জিনিয়ার।
নতুন কোর্স ধরবেন খুব আস্তে-ধীরে, ব্যালেন্স থাকা চাই। আমরা চাইব না প্যাসেঞ্জারদের গ্লাস থেকে শ্যাম্পেন ছলকে পড়ক, চাইব কি?
বিষাক্ত কালনাগিনীর ভঙ্গি নিয়ে ফ্লাইট ডেকে দাঁড়িয়ে থাকল মেয়েটা। ক্যাপটেনের সাথে কথা বলার সময় তার কণ্ঠস্বর ছিল দৃঢ়, ভাবাবেগশূন্য, ঠাণ্ডা। যৌনাবেদন নিয়ে তার দাঁড়াবার ভঙ্গি, পরনের ন্যূনতম পোশাক, সুন্দর অবয়ব, সোনালি খোঁপা-সবকিছু মিলিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেমন যেন একটা ভয় মেশানো শ্রদ্ধা এসে গেছে ওদের মনে। উত্তেজনায় তার শরীর শক্ত হয়ে গেছে, শ্লোগান লেখা পাতলা সুতী শার্টের ভেতর থেকে নিরেট গোল আকৃতি প্রকটভাবে চোখে লাগে। শরীরের মেয়ে-মেয়ে গন্ধ পাচ্ছে ওরা।
কয়েক মিনিট কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর নিস্তব্ধতা ভাঙল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার, ত্রিশ সেকেন্ড পর অপারেশন্ নরম্যাল।
ঠিক আছে, হাই ফ্রিকোয়েন্সি অন করে রিপোর্ট পাঠাও।
নাইরোবি, স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো থেকে বলছি।
বলুন, স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো।
মাছে, হেডসেটে বলল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।
রজার, জিরো-সেভেন-জিরো। চল্লিশ মিনিট পর আবার রিপোর্ট করুন।
জিরো-সেভেন-জিরো।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মেয়েটা। সেট অফ কর, বলে ক্যাপটেনের দিকে ফিরল সে। ফ্লাইট ডাইরেক্টর ডিজএনগেজ করুন, বাক নিয়ে নতুন কোর্স ধরুন হাত দিয়ে-দেখা যাক কতটা নরমভাবে কাজটা আপনি করতে পারেন।
প্লেন চালনা কৌশলের অপূর্ব প্রদর্শনী চাক্ষুষ করল মেয়েটা, মাত্র দুমিনিটে ছিয়াত্তর ডিগ্রী দিক্ বদল সহজ কথা না। টার্ন অ্যান্ড-ব্যালেন্স ইন্ডিকেটরের কাটা এক চুল এদিক ওদিক নড়ল না। বাক নেয়া শেষ হতে এই প্রথমবারের মতো হাসল স্বর্ণকেশী।
মুক্তার এক ঝলক দ্যুতি ছড়ানো চোখ ধাঁধানো হাসি।
গুড, বলল সে, সরাসরি ক্যাপটেনের মুখের ওপর হাসছে। আপনার নাম কি?
সিরিল, এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল ক্যাপটেন।
আমাকে আপনি ইনগ্রিড বলে ডাকতে পারেন, আহ্বান জানাল সুন্দরী।
.
পিটার স্ট্রাইডের নতুন চাকরিতে বাঁধা-ধরা কোনো রুটিন নেই, তবে পিস্তল আর অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে প্র্যাকটিস করা বাধ্যতামূলক। থোর কমান্ডের সবাইকে, এমন কি টেকনিশিয়ানদেরও, দৈনিক এক ঘণ্টা রেঞ্জ প্র্যাকটিস করতেই হবে।
দিনের বাকি সময় বিরতিহীন ব্যস্ততার মধ্যে কাটে পিটারের। ওর কমান্ড এয়ারক্রাফটে নতুন ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট বসানো হয়েছে সেগুলোর নাড়ি-নক্ষত্র জানার জন্যে এক্সপার্টদের সাথে থাকতে হয় ওকে। সকালের অর্ধেক এই দুই কাজে বেরিয়ে যায়। তারপর তাড়াহুড়ো করে ছুটতে হয় স্ট্রাইকার ফোর্সের সাথে যোগ দেয়ার জন্যে। দিনের অনুশীলন শুরু করার জন্যে ওর অপেক্ষায় হারকিউলিস ট্রান্সপোর্ট প্লেনের মেইন কেবিনে বসে থাকে সবাই।