রোলেক্সের আলোকিত ডায়ালে চোখ রাখল পিটার। এগারোটা বাজতে ষোলো মিনিট বাকি। ঠিক এই মুহূর্তে জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে এমন একটা কাজে হাত দিতে যাচ্ছে ও। এর পরিণতি কি হতে পারে ওর জানা নেই। কিন্তু সে ব্যাপারে চিন্তিত নয় ও। যাই ঘটুক, পরে দেখা যাবে।
মুঠো পাকানো ডান হাতটা মাথার ওপর তুলল পিটার, দুসেকেন্ড ওভাবে রাখল, তারপর নামিয়ে আনল ঝট করে। সিগন্যাল পেয়ে স্টিক দুজন দ্রুত সামনে বাড়ল, বুটে রাবার সোল থাকায় কোনো শব্দ হলো না, পিঠের সাথে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা গ্যাস সিলিন্ডার আর প্রোব।
ধীরে ধীরে পাঁচ পর্যন্ত গুনল পিটার, উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে শরীর। ডক্টর পার্কারের নির্দেশ এখনো পরিষ্কার বাজছে ওর কানে। সব ভুলে গিয়ে আবার সিগন্যাল দিল পিটার, ছায়া থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে রওনা হয়ে গেল অ্যাসল্ট টিম, ওদের তিনজন অ্যালুমিনিয়ামের একটা মই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, চারজনের কাঁধ থেকে স্ট্র্যাপের সাথে ঝুলছে স্টার গ্রেনেড ভরা ব্যাগ, অন্যান্যদের হাতে স্ন্যাপ হ্যাঁমার–প্লেনের দরজায় লাগানো তালা ভাঙার কাজে দরকার হবে ওগুলো। প্রায় কোনো আওয়াজ না করে ছুটল ওরা, প্রত্যেকে শুধু তার নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে।
টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের আলোর আভায় স্টিক দুজনকে দেখতে পেল পিটার, নাক বরাবর সামনে, প্লেনের ফুলে থাকা রুপালি পেটের নিচে পজিশন নিয়েছে। ভিজে টারমাক চকচক করছে। বিস্ফোরণের আওয়াজ পেয়ে ছ্যাৎ করে উঠল পিটারের বুক, সেই সাথে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোর বন্যায় ভেসে গেল চারদিক। তারপরই অন্ধকার, কিন্তু আবার যে কোনো মুহূর্তে চমকাতে পারে বিদ্যুৎ। বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে ডেকে ওঠার পর থামেনি মেঘ, গরগর করে গজরাচ্ছে। কালো আকাশটাকে চিরে আবার ছুটে গেল বিদ্যুৎরেখা। ঘাসের ওপর মাথা উঁচু করে ছুটছে অ্যাসল্ট টিম, সবাইকে পরিষ্কার দেখতে পেল পিটার। হাইজ্যাকাররাও কি দেখতে পেয়েছে?
মাটি ছেড়ে শক্ত টারমাকে উঠে এল ওরা। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে পিটার যে কোনো মুহূর্তে একসাথে দশ-বারোটা গ্রেনেড ছুটে আসবে। কিন্তু এল না। তারপর অনেকটা যেন হঠাৎ করেই বোয়িংয়ের ফিউজিলাজের নিচে পৌঁছে গেল সব কজন, যেন বাচ্চারা মুরগির পেটের তলায় নিরাপদ আশ্রয়ে গা ঢাকা দিল। দুটো দল চার ভাগ হয়ে গেল, প্রত্যেকে তার বা হাঁটু ভাঁজ করে টারমাকে ঠেকাল, একসাথে ঢেকে ফেলল যে যার মুখ গ্যাস মাস্ক দিয়ে। সবাইকে চট করে একবার দেখে নিয়ে ট্র্যানসিভারের বোতামে চাপ দিল পিটার, গোটা ব্যাপারটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মুখ খুলবে না ও। বলা যায় না, হয়তো একই ফ্রিকুয়েন্সি মনিটর করছে হাইজ্যাকাররা। বোতাম চাপ দেয়ার ফলে টার্মিনাল ভবনে অপেক্ষারত থোর কমান্ডের লোকজন শব্দটা শুনতে পেল-ক্লিক। এই সিগনালের জন্যেই অপেক্ষা করছিল ওরা। প্রায় সাথে সাথে দূরে গর্জে উঠল একটা জেটের একজোড়া ইঞ্জিন। উত্তর প্রান্ত ঘেঁষে ইন্টারন্যাশনাল ডিপারচার এরিয়ায় রয়েছে জেটটা, তবে জেটের এগজস্ট সার্ভিস এলাকার দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। এক এক করে আরো তিনটে জেটের তিন জোড়া ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। সবগুলোর একত্রিত আওয়াজে এত দূর থেকেও কানে তালা লাগার অবস্থা হলো। হাত তুলে সিগনাল দিল পিটার।
তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল একজন স্টিক, সিগনাল পেয়েই ড্রিলের ডগা ফিউজিলাজের গায়ে ছোঁয়াল সে। ড্রিলের আওয়াজ ওরাই কেউ শুনতে পেল না, হাইজ্যাকারদের তো আরো শুনতে না পাবার কথা। প্রেশার হাল ভেদ করে লম্বা প্রোব বোয়িংয়ের ভেতর সেঁধিয়ে গেল। সাথে সাথে দ্বিতীয় স্টিক তার প্রোব ডোকাল খুদে ফুটোর ভেতর, চট করে পিটারের দিকে একবার তাকাল সে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে পিটার। সিগনাল দিল ও, প্লেনের ভেতর গ্যাস ঢুকতে শুরু করল।
ট্র্যানসিভারের বোতামে পরপর দুবার চাপ দিল পিটার, দুসেকেন্ড পর বোয়িংয়ের পর্দা ঢাকা আলোকিত পোর্টহোলগুলো অন্ধকার হয়ে গেল একযোগে মেইন্স থেকে পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
জেট ইঞ্জিনগুলোর আওয়াজ আরো কয়েক সেকেন্ড শোনা গেল। মইবাহী লোকদের সামনের দিকে এগোবার সিগনাল দিল পিটার। রাবার প্যাড লাগানো মইয়ের মাথা মসৃণ ডানার কিনারায় ঠেকাল, তরতর করে উপর দিকে উঠে গেল গ্যাস কমান্ডোরা। গ্যাস মাস্ক পরা কালো মূর্তিগুলো দ্রুতহাতে কাজ শুরু করল।
বোয়িংয়ের কেবিনে গ্যাস ঢোকার পর দশ সেকেন্ড সময় নিল পিটার, তারপর তিনবার চাপ দিল বোতামে। সাথে সাথে মেইন্স থেকে আবার পাওয়ার সাপ্লাই শুরু হলো, প্লেনের ভেতর জ্বলে উঠল আলোগুলো। সেই সাথে এয়ারকন্ডিশনিংও চালু হলো আবার। কেবিন আর ফ্লাইট ডেক থেকে বিষাক্ত গ্যাস এবার বেরিয়ে যাবে।
কলিনের কাঁধে মৃদু টোকা দিল পিটার, বুক ভরে বাতাস টেনে ছুটল দুজন। দুই ডানার ওপর অপেক্ষা করছে দুটো দল, তাদের নেতৃত্ব দেবে ওরা।
.
এগারোটা বাজতে নয় মিনিট, ক্যারেনকে বলল ইনগ্রিড, বাইরে কোথাও জেট ইঞ্জিন চালু হওয়ায় গলা একটু চড়াতে হলো তাকে। ড্রাগের প্রভাব কমে আসায় জিভ আর গলা শুকিয়ে গেছে তার, চোখের কোণে একটা শিরা ঘন ঘন লাফাচ্ছে। মনে হলো পাকানো একটা রশি জড়ানো রয়েছে তার কপালে, কেউ সেটা ধীরে ধীরে চাপ দিয়ে আরো আঁটসাট করছে। মনে হচ্ছে হিসেবে ভুল করেছে খলিফা। দক্ষিণ আফ্রিকান সরকার হার মানতে রাজি নয়। ঠোঁট একটু বাঁকা করে ফ্লাইট ডেকের ভোলা দরজা দিয়ে ভাজ খোলা চেয়ারে বসা ক্রুদের দিকে তাকাল সে। পাকা চুল পাইলট ভার্জিনিয়া সিগারেট খাচ্ছে, নিস্তেজ চোখে ইনগ্রিডের দিকে তাকাল সে। কোনো কারণ ছাড়াই পিত্তি জ্বলে গেল ইনগ্রিডের, গলা চড়িয়ে বলল, এই দলটাকেও গুলি করতে হতে পারে।