হাঁপিয়ে গেছে ইনগ্রিড, দম নিয়ে আবার শুরু করল, আমি দুঃখিত, কিন্তু নষ্ট করার মতো আর সময় নেই–আরো চারজন জিম্মিকে বেছে নিতে হবে আমাদের। কথা দিচ্ছি, বাছাইয়ের কাজে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হবে। সেই সাথে আপনাদের আমি এই বলে কাতর হতে নিষেধ করি যে এখানে এই মুহূর্তে যে বিপ্লব ঘটছে আপনারা আমরা সবাই তাতে সামিল হতে পেরে গর্বিত। সবাই আমরা এই ভেবে অহঙ্কার করতে পারি যে…।
অকস্মাৎ বারকয়েক বিদ্যুৎ চমকাল, সেই সাথে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। গুরু-গম্ভীর মেঘ ডাকছে। অর্থহীন পাগলের প্রলাপ বকে চলেছে ইনগ্রিড, দম ফুরিয়ে গেলে থামছে, তারপর আবার কঠিন শব্দ সাজিয়ে যা মনে আসছে তাই বলে যাচ্ছে।
সীট নম্বর ধরে আপনাদের ডাকব আমি, আবার কাজের কথায় ফিরে এল সে। আমার অফিসাররা আপনাদের নিয়ে আসবে। দয়া করে তাড়াতাড়ি আপনারা চারজন ফার্স্ট ক্লাস গ্যালিতে চলে আসবেন। বিপ্লবী ভাই এবং বোনেরা, আপনাদের কাছ থেকে আমি পূর্ণ সহযোগিতা কামনা করি। তিন সেকেন্ডের বিরতি, তারপর আবার তার গলা শোনা গেল, সীট নম্বর নাইনটি/বি। দাঁড়ান, প্লিজ।
কড়-কড়-কড়াৎ করে বাজ পড়ল কোথাও। লাফ দিয়ে ইনগ্রিডের পাশে চলে এল ক্যারেন, থরথর করে কাঁপছে সে। তার চোখ জবা ফুলের মতো লাল হয়ে উঠেছে, চোখের পাতা ভারী। চেহারায় উভ্রান্ত একটা ভাব নিয়ে কান পেতে থাকল সে, বজ্রপাতের আওয়াজকে তার ভারী ভয়। অন্যমনস্কভাবে পিঠে হাত বুলিয়ে অভয় দিল তাকে ইনগ্রিড।
লম্বা চুলে মুখ ঢাকা জার্মান যুবক কার্ট এগিয়ে গেল, নাইনটি-বি সীটের মধ্যে বয়স্ক আরোহীকে টেনে-হিঁচড়ে দাঁড় করাল সে। লোকটার একটা হাত ধরে মুচড়ে শিরদাঁড়ার কাছে নিয়ে এল।
কিছু একটা করুন আপনারা! সহ-আরোহীদের দিকে তাকিয়ে করুণ আবেদন জানাল লোকটা। তার সাদা শার্ট ঘামে ভিজে আছে। ঢিলেঢালা ট্রাউজারের ভেতর বারবার ভাজ হয়ে যাচ্ছে হাঁটু, প্যাসেজ ধরে তাকে হটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাচ। ওরা আমাকে খুন করতে নিয়ে যাচ্ছে দেখেও কেউ আপনারা কিছু করবেন না? বিস্ময়ে বিপন্ন চোখে লোকজনদের দিকে তাকাল লোকটা। প্লিজ, আমাকে বাঁচতে দিন। আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু সবাই ওরা যে যার কোলের দিকে তাকিয়ে থাকল। কেউ নড়ল না, কেউ মুখ খুলল না।
সীট নম্বর ফরটি-থ্রী/এফ।
পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের সুন্দরী এক মেয়ে, নিজের সীটের ওপর নম্বরটা দেখার সাথে সাথে তার চেহারা ধীরে ধীরে আঁচ লাগা মোমের মতো গলে যেতে শুরু করল। কান্নার আওয়াজ চাপা দেয়ার জন্যে মুখে একটা হাত তুলল সে। তার ঠিক উল্টোদিকের সীট থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন একজন, চটপটে এক বৃদ্ধ। মাথা ভর্তি প্রচুর চুল, সব সাদা হয়ে গেছে, ক্লিনশেভড। সপ্রতিভ ভাবে তিনি তার টাইটা ঠিক করলেন।
ফিসফিস করে তিনি বললেন, আমার সাথে সীট বদল করবে, ম্যাডাম, প্লিজ? বড় বেশি স্পষ্ট উচ্চারণ কণ্ঠস্বরে বিদেশি টান। কথা শেষ করে উত্তরের অপেক্ষায় থাকলেন না, প্যাসেজে বেরিয়ে সহজ ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগলেন। হনহন করে এগিয়ে আসছিল ফরাসি যুবক হেনরি, বৃদ্ধের কনুই চেপে ধরল সে। আঁকি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন তিনি, দৃঢ়পায়ে একাই ফরওয়ার্ড গ্যালিতে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
.
বোয়িং জিরো-সেভেন-জিরোর সবচেয়ে দুর্বল জায়গা চিহ্নিত করা হলো। ফ্লাইট ডেকের পাশের জানালাগুলো থেকে বিশ ডিগ্রী কোণ সৃষ্টি করে পিছনের লেজ পর্যন্ত যে জায়গাটুকু রয়েছে সেখানে প্লেন থেকে কারও চোখ পড়বে না। হাউজ্যাকারদের সাথে অত্যাধুনিক ইকুইপমেন্ট রয়েছে, এবং তাদের আত্মবিশ্বাস আকাশচুম্বী, কাজেই দুর্বল জায়গাটার ওপর কড়া নজর রাখছে বলে মনে হয় না।
মেইন সার্ভিস হ্যাঙ্গারের চার্ট রয়েছে কলিনের, মন দিয়ে পিটারের কথা শুনছে সে। সরাসরি বোয়িংয়ের পিছনে রয়েছে ওরা, মাঝখানে চারশ গজের কিছু বেশি দূরতু, তার অর্ধেকটাই হাঁটু সমান উঁচু ঘাসে ঢাকা, বাকিটা টারমাক। টারমাক শুধু ট্যাক্সিওয়ের নীল আলোয় আর এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের সাদা আভায় আলোকিত হয়ে আছে। এয়ারপোর্টের সব আলো নিভিয়ে দেয়ার কথা ভেবেছিল পিটার, পরে বাতিল করে দিয়েছে চিন্তাটা। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলে হাইজ্যাকাররা বিপদ টের পেয়ে যাবে, বোয়িংয়ের কাছে পৌঁছুতে অ্যাসল্ট টিমেরও অসুবিধে হবে।
কই, কিছুই তো দেখছি না, চোখ থেকে নাইট গ্লাস নামিয়ে বলল কলিন। অনেক আগেই নিভে গেছে তার চুরুট, তবু ফেলছে না সেটা। ব্লাইন্ড স্পটে ওরা নজর রাখছে না।
দুজনেই ওরা একজন এন.সি. ও-র হাতে নিজেদের নাইট গ্লাস ধরিয়ে দিল, ওগুলো আর দরকার হবে না। একান্ত প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট ছাড়া বাকি সব কিছু ফেলে রেখে যাচ্ছে অ্যাসল্ট টিম।
টার্মিনাল ভবনে নিজের লোকদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্যে হালকা, এগারো আউন্সের একটা ভি, এইচ, এফ, ট্রানসিভার সেট নিয়েছে পিটার, আর শুধু একটা ওয়ালথার পি. কে, থারটি এইট অটোমেটিক পিস্তল। নিতম্বের কাছে কুইক রিলিজ হোলস্টারে রয়েছে ওটা। অ্যাসল্ট টিমের অন্যান্য সদস্যরা যে যার পছন্দ মতো অস্ত্র বেছে নিয়েছে। কলিন নিয়েছে ব্রাউনিং হাই-পাওয়ার পয়েন্ট ফরটিফাইভ, ম্যাগাজিনে চৌদ্দ রাউন্ড গুলি। সবাই ওরা সুপার ভেলেক্স এক্সপ্লোসিভ বুলেট ভরেছে যে যার অস্ত্রে-ধাক্কা লাগার সাথে সাথে ধরাশায়ী হবে টার্গেট, শরীরের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটায় ভেদ করে বেরিয়ে আর কাউকে আহত করার আশঙ্কা নেই।