চোখে বিনকিউলার তুলে বোয়িং জিরো-সেভেন-জিরোর লেজ থেকে নাক পর্যন্ত দেখল পিটার, কোথাও প্রাণের কোনো লক্ষণ নেই। প্রতিটি পোর্ট আর জানালা ভেতর থেকে বন্ধ। তারপর, অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিনকিউলার একটু নিচু করে প্লেনের পাশে টারমাকে তাকাল ও। লাশগুলো স্তূপ হয়ে এখনো পড়ে রয়েছে ওখানে।
বিনকিউলার নামাল পিটার, একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে উঠে এল এয়ার ট্রাফিক টাওয়ারে। সিনিয়র এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের পাশে দাঁড়াল ও। আমি আবার একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই। সাথে সাথে ওর হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দেয়া হলো।
স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো, দিস ইজ টাওয়ার। ইনগ্রিড, ডু ইউ রিড মি? কাম ইন, ইনগ্রিড।
গত কয়েক ঘণ্টায় দশ-এগারোবার যোগাযোগ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে পিটার হাইজ্যাকাররা কোনো সাড়া দেয়নি।
ইনগ্রিড, কাম ইন, প্লিজ। হাল না ছেড়ে আবার ডাকল পিটার।
হঠাৎ করেই প্রাণবন্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, দিস ইজ ইনগ্রিড। কি চাই তোমার?
ইনগ্রিড, অনুরোধ করছি অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে লাশগুলো সরিয়ে আনার অনুমতি দাও।
নেগেটিভ, টাওয়ার। আই সে এগেন, নেগেটিভ। প্লেনের ধারেকাছে কেউ আসতে পারবে না। এক সেকেন্ড থামল সে। এত তাড়া কিসের, আরো বারোটা। লাশ এখানে জমুক না, তখন সব একসাথে সরিয়ে নিতে পারবে। খিলখিল করে হাসল সে। মাঝরাত পর্যন্ত সবুর কর, কথা দিচ্ছি মেওয়া ফলবে।
ক্লিক শব্দ করে স্তব্ধ হয়ে গেল রেডিও।
.
এখন আপনাদের ডিনার পরিবেশন করা হবে, সহাস্যে ঘোষণা করল ইনগ্রিড, এবং আশ্চর্য, এত আতঙ্ক আর দুর্ভাবনার মধ্যেও উৎসাহের সাথে নড়েচড়ে বসল আরোহীরা। আপনারা জেনে খুশি হবেন আজ আমার জন্মদিন। কাজেই ডিনারের পর সবাইকে শ্যাম্পেনও দেয়া হবে। কি মজা, তাই না?
কিন্তু ছোটখাটো, মোটাসোটা ইহুদি ডাক্তার হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল, তার মাথার কগাছি সাদা চুল খাড়া হয়ে থাকায় কৌতুককর লাগছে দেখতে। তারপর মুখ যেন ভেতর দিকে দেবে গেছে, মনে হলো গলতে শুরু করা মোমের তৈরি বিধ্বস্ত একজন মানুষ, শোকে কাতর-কি বলা হচ্ছে বা কি ঘটছে সে ব্যাপারে তার যেন কোনো হুঁশ নেই।
কেন, কেন? কোন অধিকারে? কি করেছিল সে তোমার? বুড়ো মানুষের মতো কেঁপে গেল তার গলা। ওর মতো মেয়ে হয় না, তাকে তুমি বিনা কারণে মেরে ফেললে! জীবনে কখনো কারো মনে দুঃখ দেয়নি…।
আপনার স্ত্রীর কথা বলছেন? তাকে থামিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল ইনগ্রিড। ভালো ছিল? বিদ্রুপের হাসি হাসল সে। কেউ ভালো নয়, কেউ নিরীহ নয়, আপনারা সবাই আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের নোংরা উপকরণ।
হঠাৎই থেমে গেল ইনগ্রিড, নিজেকে সামলে নিয়ে ডাক্তারের কাঁধে হাত রাখল একটা জোর করে হাসল একটু। বসুন, বলল সে প্রায় কোমল সুরে। আপনার কেমন লাগছে আমি জানি, প্লিজ বিশ্বাস করুন। অন্য কোনো উপায় থাকলে সত্যি ভালো হতো।
ধপ করে বসে পড়ল ডাক্তার, চোখে শূন্য দৃষ্টি, এক হাতের আঙুল দিয়ে আরেক হাতের আঙুল অকারণেই নাড়াচাড়া করছে।
শান্ত হোন, শান্ত হয়ে বসে থাকুন, নরম সুরে বলল ইনগ্রিড। আমি নিজে আপনাকে এক গ্লাস শ্যাম্পেন এনে দিচ্ছি।
.
মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার,–প্রায় দুটো দিন আর দুটো রাত বিরতিহীন উদ্বেগের মধ্যে থেকে কেনি কনস্টেবলের কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে গেছে,-দশটার বেশি বেজে গেছে। হাতে আর দুঘণ্টা সময়ও নেই, সিদ্ধান্ত যা নেয়ার এখনি নিতে হবে। তা না হলে কি ঘটবে সবাই আমরা জানি।
গুঞ্জন থামাবার জন্যে লোমশ একটা হতে তুললেন প্রাইম মিনিস্টার।
হাজার মাইল দূরবর্তী জোহানেসবার্গ থেকে ভিডিও টেপের একটা কপি আনানো হয়েছে প্লেনে করে, উপস্থিত সবাই চাক্ষুষ করেছেন জিম্মিদের হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ড। টেবিলে এমন একজন লোক নেই যে নিঃসন্তান। ওদের মধ্যে যারা ডানপন্থী রাজনীতি করেন, চেহারায় অনিশ্চিত ভাব নিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছেন তারা। এমনকি লৌহমানব বলে খ্যাত মিনিস্টার অভ পুলিস পর্যন্ত চোখ তুলে অ্যামব্যাসাডারদের দিকে তাকাতে পারেননি।
এবং এও আমরা জানি টেরোস্টিদের সবগুলো দাবি পুরোপুরি মেনে না নিলে আপোষের কোনো সম্ভাবনা নেই…
আবার কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার মধ্যে কাটল সময়, তারপর প্রাইম মিনিস্টার মুখ খুললেন, মি. অ্যামব্যাসাডর, আমরা যদি দাবিগুলো মেনে নিইও, মেনে নেব শুধু মানবিক কারণে। আরোহীরা আপনাদের নাগরিক, তাদের নিরাপত্তার জন্যে বড় বেশি চড়া মূল্য দিতে হবে আমাদের–কিন্তু যদি এই মূল্য দিই আমরা, কাল বাদে পরশু কি নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিটেন আর আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন পাব আমরা?
কেনি কনস্টেবল বললেন, আমার প্রেসিডেন্ট আমাকে ক্ষমতা দিয়েছেন, আমি যেন আপনার সহযোগিতার বিনিময়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সম্ভাব্য সব রকম সাহায্যের প্রস্তাব দিই।
ওই একই ক্ষমতা হার ম্যাজেস্টিজ গভর্নমেন্ট আমাকেও দিয়েছে, তাল মেলালেন স্যার উইলিয়াম এবং আমার সরকার একশ সত্তর মিলিয়ন ডলারের মোট একটা অংশ জোগান দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
তবু আমি একা সিদ্ধান্ত নেয়ার কেউ নই। একজনের পক্ষে ব্যাপারটা বড় বেশি ভারী। প্রাইম মিনিস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি আমার মন্ত্রীদের কাছে ভোট চাইব, কাজেই আপনারা কমিনিটের জন্যে, প্লিজ…