ভয়-ভাবনায় অস্থির এবং অসহায় পিটার কি করবে বুঝতে না পেরে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কি ঘটতে যাচ্ছে জানে, কিন্তু ঠেকাবার কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছে না।
জ্যাম্প! জোরে চিৎকার করল পিটার, মেয়েটার দিকে দুহাত তুলে দিল। লাফ দাও, তাড়াতাড়ি! আমি তোমাকে ধরব।
কিন্তু হ্যাচ থেকে টারমাক প্রায় ত্রিশ ফিট নিচে, মেয়েটা ইতস্তত করতে লাগল। একবার মনে হলো এই লাফ দিল, কিন্তু তাল সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল নিজের জায়গায়। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে।
মরে যেতে ইচ্ছে করল পিটারের। ওর এই অসহায় অবস্থার জন্যে নিয়তি নাকি স্রষ্টা কার ওপর জানে না, এমন প্রচণ্ড রাগ হলো, মনে হলো আত্মহত্যা করে।
মেয়েটার দশ কদম পিছনে, ক্যারেন আর ইনগ্রিড পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে, একযোগে দুজনেই পিস্তল তুলল তারা। দুহাতে ধরে আছে পিস্তল, নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে টার্গেট।
লাফ দাও, ফর গডস সেক লাফ দিয়ে পড়! তোমার কোনো ভয় নেই! পিটারের কণ্ঠস্বর কেবিনের ভেতর থেকে পরিষ্কার শোনা গেল ক্ষীণ একটু বিদ্রুপের হাসি ফুটল ইনগ্রিডের ঠোঁটে।
নাউ! বলল, সে এবং দুজন একসাথে গুলি করল। বিস্ফোরণের জোড়া শব্দ একটা শোনাল, হাঁ করা মাজল থেকে বেরোল নীলচে ধোয়া, বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। কাঁচা মাংসের ভেতর বুলেট বিদ্ধ হবার আওয়াজগুলো অদ্ভুত কোমল শোনাল, কেউ যেন তরমুজের ফালি ছুঁড়েছে দেয়ালে।
ক্যারেনের চেয়ে একটু আগে দ্বিতীয় ব্যারেলটা ফায়ার করল ইনগ্রিড, এবার তাই জোড়া বিস্ফোরণের আওয়াজ আলাদা আলাদা ভাবে চেনা গেল। তারপরই সব নিস্তব্ধ, পিন-পতন স্তব্ধতা নেমে এল। মাত্র এক মুহূর্ত, আচমকা ওদের পুরুষ সঙ্গীরা গর্জে উঠল।
কেউ নড়বে না! এভরিবডি ফ্রিজ!
.
সেকেন্ডের ওই ভগ্নাংশগুলো দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা বলে মনে হলো পিটারের। থেমে যাওয়া সময় যেন ওর মাথায় বিচিত্র এক খেলায় মেতে থাকল, যেন কোনো ছায়াছবির কিম্ভুতকিমাকার একাধিক দৃশ্য স্থির হয়ে গেছে।
প্রথম বিস্ফোরণের পুরো ধাক্কাটা খেল অন্তঃসত্ত্বা মহিলা। বেশি পেকে যাওয়া ফলের মতো ফেটে গেল সে, সীসাগুলো শিরদাঁড়া থেকে নাভি পর্যন্ত পথ করে নেয়ায় তার ফোলা শরীর আকৃতি বদল করল। সামনের দিকে ছিটকে পড়ল সে, শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে বস্তার মতো পড়ল টারমাকের ওপর, প্রাণবায়ু আগেই বেরিয়ে গেছে।
মোটাসোটা মহিলা পাশে দাঁড়ানো ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরেছিল, খোলা দোরগোড়ায় ঝুঁকে দেখতে লাগল দুজনেই, ঝাঁক ঝাঁক সীসা ওদের যেন নাচতে বাধ্য করেছে, মান নীলচে ধোয়া মোচড় খাচ্ছে ওদের ঘিরে। আঁটসাট সিল্ক ড্রেসে পনেরো-বিশটা ফুটো দেখা গেল, ধারালো কিছু দিয়ে কেউ যেন খোঁচা মেরেছে তাকে। ছেলেটার সাদা স্কুল-শার্ট ভেদ করেও ভেতরে ঢুকল অনেক গুলি, প্রতিটি ফুটোর কিনারা রঙিন হয়ে উঠল সাথে সাথে। কেউ ওরা কোনো শব্দ করেনি। দুজনের চেহারাতেই ঘোর বিস্ময় আর উদভ্রান্ত ভাব। পরের বিস্ফোরণটা কঠিন ধাক্কা মারল ওদেরকে, ছিটকে শূন্যে পড়ার সময় মনে হলো ওদের যেন কোনো হাড় নেই। তখন ও দুজন জড়াজড়ি অবস্থায় রয়েছে। পিটারের মনে হলো ওরা যেন অনন্তকাল ধরে পড়ছে আর পড়ছে।
কিশোরী মেয়েটা পড়ে যাচ্ছে দেখে ধরার জন্যে সামনের দিকে ছুটল পিটার, তার ভার সামলাতে না পেরে ভাজ হয়ে গিয়ে টারমাকে ঠেকে গেল পিটারের হাটু। দৌড়াতে শুরু করে সিধে হলো পিটার, ঘুমন্ত শিশুর মতো তাকে বয়ে নিচে চলেছে, একটা হাত তার হাঁটুর নিচে, আরেক হাত কাঁধ জড়িয়ে আছে। মেয়েটার ছোট্ট, সুন্দর মাথা ওর কাঁধে বাড়ি খেতে লাগল, মিহি চুলগুলো ওর চোখেমুখে সেঁটে গেল, প্রায় অন্ধ করে রাখল ওকে।
মরো না! নিঃশ্বাসের সাথে অস্ফুট শব্দগুলো বেরিয়ে এল, নিজের অজান্তেই মিনতি জানাচ্ছে পিটার। প্লিজ, ডোন্ট ডাই! তলপেটে গরম রক্তের স্রোত অনুভব করল ও, উরু বেয়ে নেমে যাচ্ছে পায়ের দিকে। অনেক রক্তপাত হচ্ছে। একসময় ভিজিয়ে দিল ওর পায়ের পাতা। টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের প্রবেশপথ থেকে দশ কদম ছুটে এল কলিন নোবলস, চেষ্টা করল পিটারের হাত থেকে মেয়েটাকে তুলে নিতে। কিন্তু খ্যাপা পশুর মতো তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল পিটার। থোর কমান্ডের ডাক্তার অপেক্ষা করছিল, কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে কিছু বলার ব্যর্থ চেষ্টা করে তার হাতে মেয়েটাকে তুলে দিল ও।
দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছে পিটার। সারা মুখে কঠিন রেখা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল ও।
একটু পরই মুখ তুলে তাকাল ডাক্তার। দুঃখিত, স্যার। শি ইজ ডেড।
এ যেন পিটারের ব্যক্তিগত পরাজয়। স্তম্ভিত চেহারা নিয়ে ডাক্তারের দিকে এক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল ও, তারপর ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
নির্জন টার্মিনাল ভবনের মার্বেল পাথরে পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, একটু পিছনে ওকে অনুসরণ করছে কলিন। দুজনের চেহারাই নির্লিপ্ত। কমান্ড এয়ারক্রাফটে চড়ার সময়ও কেউ ওরা কথা বলল না।
.
স্যার উইলিয়াম, রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিনা বিচারে আটক রেখেছি বলে আপনি আমাদের অভিযুক্ত করছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডরের দিকে তর্জনী তাক করলেন। কিন্তু আপনারা ব্রিটিশরা যখন প্রিভেনশন অভ টেরোরিস্ট অ্যাক্ট পার্লামেন্টে পাস করলেন তখন নাগরিকদের অধিকার হেবিয়াস কর্পাস প্রয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তারও আগে সাইপ্রাস, এবং প্যালেস্টাইনে এই আপনারাই তো বিনা বিচারে হাজার হাজার লোককে আটক রেখেছিলেন আজই বা আপনারা কি করছেন–আয়ারল্যান্ডে? ওখানে আপনারা মুক্তিকামী মানুষের নেতাদের বিনা বিচারে আটক রাখেননি?