কি বলবে, না? আবার ইনগ্রিডের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক হয়ে এল। হ্যাঁ, একটা উত্তর পাওনা হয়েছে ওদের। পিস্তল নিচু করে কবজিতে বাধা জাপানি হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলাল। তিন মিনিট হলো ডেডলাইন পেরিয়ে গেছ, উত্তর তো একটা পেতেই হবে ওদের। নিজের চারদিকে এমনভাবে তাকাল সে, যেন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছে।
ওষুধটার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে, ভাবল পিটার। হয়তো বেশি হয়ে গেছে ডোজ। কিংবা যে প্রেসক্রাইব করেছে তার জানা ছিল না উত্তেজিত অবস্থায় আটচল্লিশ ঘণ্টা জেগে থাকার পর খাওয়া হবে ওষুধটা।
আমি অপেক্ষা করছি, শান্তভাবে বলল পিটার।
হ্যাঁ, দাঁড়াও। প্লেনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল ইনগ্রিড।
.
দুর্ভাগা চারজন জিম্মির দিকে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্যারেন, ঘাড় ফিরিয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে ইনগ্রিডের দিকে তাকাল সে। ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল ইনগ্রিড, আবার বন্দীদের দিকে ফিরল ক্যারেন। এসো, কোমল গলায় বলল সে। তোমাদের মুক্তি দেয়া হচ্ছে। প্রায় আদর করে গর্ভবতী মহিলাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল সে।
ক্যারেনকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত পিছনের কেবিনে চলে গেল ইনগ্রিড। কার্টের সাথে চোখাচোখি হতে ছোট্ট করে আবার মাথা ঝাঁকাল সে। মাথা ঝাঁকি দিয়ে চুলগুলো মুখ থেকে সরাল কার্ট, পিস্তলটা বেল্টে গুঁজে নিল। মাথার ওপর লকার থেকে একজোড়া প্রাস্টি গ্রেনেড বের করল সে, এক এক করে দুটোরই পিন খুলল, রিঙ দুটো জড়িয়ে নিল দুহাতের কাড়ে আঙুলে। ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মতো হাত দুটো ভাজ আর উঁচু করে প্যাসেজ ধরে হালকা পায়ে ছুটল সে। গ্রেনেডগুলো এখন জ্যান্ত, হাত থেকে পড়ে গেলেই বিস্ফোরিত হবে। কেউ নড়বে না, কেউ নিজের সীট ছেড়ে উঠবে না-যাই ঘটুক না কেন। যে যেখানে আছে সেখানেই থাকো!
হেনরি একই ভঙ্গিতে ছুটল,-তারও দুহাতে দুটো জ্যান্ত গ্রেনেড, সেও একই কথা বলে সাবধান করে দিল সবাইকে। কেউ নড়বে না। কোনো কথা নয়। সীট ছাড়বে না। সবাই চুপ! জার্মানি এবং ফরাসি ভাষায় পুনরাবৃত্তি করল সে। রক্তের নেশায় তার চোখ জোড়াও অস্বাভাবিক চকচক করছে।
ফ্লাইট ডেকের দিকে পিছন ফিরল ইনগ্রিড। এসো, লক্ষ্মীটি। ছোট্ট মেয়েটার কাঁধে একটা কোমল হাত রাখল সে, তাকে দাঁড় করিয়ে খোলা হ্যাচওয়ের দিকে নিয়ে চলল। কিন্তু দুপা এগিয়েই কুঁকড়ে পিছিয়ে আসার চেষ্টা করল মেয়েটা।
আমি তো কিছু করিনি, আমাকে ছেড়ে দাও, ফিসফিস করে বলল সে, তার চোখ জোড়া আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। তোমার সব কথা শুনব আমি, প্লিজ। ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল সে, পিছিয়ে গেল।
ছেলেটার বয়স আরো কম, বিপদের সত্যিকার চেহারা জানা নেই। বলতেই ইনগ্রিডের হাত ধরল সে। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল তার, মুখে খয়েরি রঙের অনেক তিল, মধুরঙা চোখে একটু বিস্ময় এবং অনিশ্চিত ভাব। জিজ্ঞেস করল, ওখানে কি বাবা আমাকে নিতে এসেছে?
তবে আর বলছি কি! তোমার বাবা এসেছেন বলেই তো তোমাকে যেতে দিচ্ছি, এসো, এসো। একটু পরই তার সাথে দেখা হবে তোমার। খোলা হ্যাচওয়ের সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল ইনগ্রিড। লক্ষ্মী ছেলের মতো এখানে একটু দাঁড়িয়ে থাকো।
.
ছেলেটাকে খোলা হ্যাচের সামনে দাঁড়াতে দেখল পিটার, কি ঘটতে যাচ্ছে পরিষ্কার ধারণা নেই। ছেলেটার পাশে মোটাসোটা, মধ্যবয়স্কা এক মহিলা দাঁড়াল, পরনে খুব দামি সিল্ক ড্রেস, গলায় হীরে বসানো নেকলেস। মহিলার মাথায় চূড়া আকৃতির খোঁপা, খুচরো কিছু চুল কানের কাছে রিঙ তৈরি করেছে। চেহারায় কোমল, মাতসুলভ একটা ভাব, ছেলেটার কাঁধে আগলে রাখার ভঙ্গিতে একটা হাত রাখল সে।
তার পাশে এসে দাঁড়াল লম্বা, কম বয়েসী এক মহিলা। তার গায়ের সাদা রঙ কেমন যেন ফ্যাকাসে, কান্নাকাটি করায় নাকের ডগা আর চোখের পাতা ফুলে আছে। কনুইয়ের ওপর হাত আর গলায় অসংখ্য লাল লাল দাগ, সম্ভবত অ্যালার্জি। ঢিলেঢালা সুতী কাপড় পরে আছে সে, কাপড়ের নিচে থেকে বেঢপভাবে ফুলে আছে পেট। দাঁড়াবার ভঙ্গিটা আড়ষ্ট, রোদের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করতে লাগল।
আরো একজনকে খোলা হ্যাচের সামনে আসতে দেখল পিটার। কিশোরী একটা মেয়ে। আচমকা পাজরের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা বোধ করল পিটার, মনে হলো মেয়েটা মেলিসা জেইন। কিন্তু সে যে মেলিসা নয়, এটা উপলব্ধি করতে বারো সেকেন্ড সময় লাগল পিটারের। তবে চেহারা অনেকটা মেলে–চোখ ভরা সরলতা, মুখে দেবীসুলভ পবিত্রতা। এমন একটা বয়স যখন সবেমাত্র লকলকিয়ে বেড়ে উঠতে শুরু করেছে শরীর। সরু, লম্বা পা, ছেলেদের মতো কোমর আর নিতম্ব।
তার বড় বড় চোখে নগ্ন ভীতি এবং পিটারকে দেখে একপলকেই বুঝে নিল একমাত্র ওই তাকে উদ্ধার করতে পারে। সংশয় আর আতঙ্ক মেশানো দৃষ্টিতে করুণ আবেদন ফুটে উঠল, সাথে যোগ হলো আশার আলো। প্লিজ, বিড়বিড় করে বলল সে। ওদের বারণ করুণ? এত আস্তে, কোনোরকমে শুনতে পেল পিটার। প্লিজ, স্যার! প্লিজ হেল্প আস!
কিন্তু ওখানে ইনগ্রিড রয়েছে, শান্ত গলাতেই কথা বলছে সে, কিন্তু পিটারের কানে তার কথাগুলো দ্রিম দ্রিম ঢাক পেটাবার মতো বাজল।
আমরা যা বলি তা করি। একটা করে ডেডলাইন পেরোবে আর একটা করে হত্যাকাণ্ড ঘটবে! আমাদের প্রমাণ করতে হবে বিপ্লবের প্রশ্নে আমরা দয়ামায়াহীন। আমরা চাই তোমরা জানো দাবির ব্যাপারে কোনো আপোষ নেই, দর কষাকষি চলবে না। একটু থেমে দম নিল সে। পরবর্তী ডেডলাইন আজ মাঝরাত। ওই সময়ের মধ্যে আমাদের সব দাবি মেনে নেয়া না হলে, আবার চরম মূল্য দিতে হবে। থামল সে, তারপর বাঘের তাড়া খাওয়া মানুষের মতো আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল তার গলা থেকে, এই হলো চরম মূল্যের নমুনা! পরমুহূর্তে পিছিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।