হাঁটতে হাঁটতে আরোহীদের মধ্যে সিগারেট বিলি করল ইনগ্রিড-বাচ্চা ছেলেমেয়েদের গাল টিপে দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল, সান্ত্বনা আর অভয় দিল কোনো মাকে-শান্ত এবং হাসিখুশি। এরই মধ্যে আরোহীরা তাকে সবার চেয়ে ভালো, লক্ষ্মী মেয়ে বলে চিহ্নিত করেছে।
ফার্স্ট ক্লাস গ্যালিতে ফিরে এসে এক এক করে সহকর্মীদের ডেকে খেতে দিল ইনগ্রিড। এক-একজন তিন-চারটে করে সেদ্ধ ডিম, মাখন দেয়া রুটি, যত খুশি বিস্কিট, পেস্ট্রি, আর স্যান্ডউইট পেল। দুর্বল হওয়া চলবে না, বলল ইনগ্রিড। পিল ওরা খাবে, কিন্তু দুপুরের আগে নয়। ড্রাগের প্রভাব থাকবে বেশি হলে বাহাত্তর ঘণ্টা, তারপর সাবজেক্টের শারীরিক বা মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জোর করে কিছু বলা সম্ভব নয়–হয়তো অলস হয়ে উঠবে, ইতস্তত করবে সিদ্ধান্ত নিতে। প্রস্তাবটা অনুমোদনের জন্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো হবে নিউ ইয়র্ক-সময় আগামী সোমবার দুপুরে, তারমানে স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যে সাতটায়। ওই সময় পর্যন্ত নিজের দলকে সম্পূর্ণ সতর্ক এবং তৎপর রাখতে চায় ইনগ্রিড, কাজেই সময়ের আগে ড্রাগ ব্যবহার করে ঝুঁকি নিতে রাজি নয় সে।
তবে ক্লান্তি তাকেও কাবু করে ফেলছে। ইতোমধ্যে চুপিচুপি বাথরুমের আয়নায় নিজের চেহারা দেখে এসেছে সে বেশ কয়েকবার। চোখ এমন লাল হয়ে উঠেছে যে রীতিমতো ভয় ধরে গেছে তার। হাঁটাচলার মধ্যে একটা অনিচ্ছাকৃত আঁকি এসে যাচ্ছে, সামান্য কারণে ঘেমে যাচ্ছে হাতের তালু, অকারণে চমকাচ্ছে-নার্ভাস হয়ে পড়ার লক্ষণ।
জার্মান যুবক, কার্ট, পাইলটের সীটে নেতিয়ে আছে। কোলের ওপর পিস্তল মৃদু নাক ডাকছে, লাল শার্টের বোতাম নাভি পর্যন্ত খোলা। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ঘন লোমে ভরা চওড়া ছাতিটা উঠছে আর নামছে। কার্ট দাড়ি কামায়নি, লম্বা মাথার চুলে ঢাকা পড়ে রয়েছে মুখের একটা অংশ। তার ঘামের গন্ধ নাকে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠল ইনগ্রিড, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। কার্টের চেহারায় অদ্ভুত একটা বুনো, নিষ্ঠুর ভাব আছে। হঠাৎ করে কার্টকে তার এই মুহূর্তে পেতে ইচ্ছে করল।
কিন্তু অনেক চেষ্টা করে কার্টের ঘুম ভাঙিয়েও কোনো লাভ হলো না। রক্তবর্ণ ঢুলু ঢুলু চোখে তাকাল সে, উত্তেজিত হবার কোনো লক্ষণ নেই। শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করে ককপিট থেকে বেরিয়ে গেল ইনগ্রিড।
পরমুহূর্তে কি মনে করে আবার ককপিটে ঢুকল সে, প্রায় ছোঁ দিয়ে হাতে নিল মাইক্রোফোনটা, প্যাসেঞ্জার কেবিনের লাউডস্পীকারের সুইচ অন করল।
সবাইকে বলছি, গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘোষণা। বিনা প্ররোচনায় সবার ওপর প্রবল আক্রোশ অনুভব করল সে। সুখে-শান্তিতে জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই লোকগুলোই তো বুর্জোয়া, ভাবল সে, তার বাপের মতো এরাও সবাই সুবিধাভোগী। গাল দিয়ে ভূত ছাড়াল ইনগ্রিড। নিজের কণ্ঠস্বর নিজেই সে চিনতে পারল না, লোকগুলোর প্রতি ঘৃণায় তার শরীর রী রী করতে লাগল।
একটানা দশ মিনিট অনলবর্ষী বক্তৃতা দেয়ার পর থামল সে। তারপর আবার তিন ঘণ্টার মধ্যে অত্যাচারী প্রতিপক্ষের তরফ থেকে সাড়া না পেলে আমরা জিম্মিদের খুন করতে শুরু করব, হুমকির সুরে পুনরাবৃত্তি করল সে, আর মাত্র তিন ঘণ্টা।
শিকারি নেকড়ের মতো প্যাসেজে পায়চারি শুরু করল ইনগ্রিড।
দুঘণ্টা, আরোহীদের বলল সে। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে কুঁকড়ে সরে যাবার চেষ্টা করল লোকজন।
এক ঘণ্টা, উল্লাসে ফেটে পড়ল তার কণ্ঠস্বর। এখুনি জিম্মিদের মধ্যে থেকে লোক বাছাই করা হবে।
কিন্তু আপনি কথা দিয়েছিলেন, করুণ মিনতি ভরা গলায় আবেদন জানাল ছোটখাট ডাক্তার। ইনগ্রিড তার স্ত্রীর হাত ধরে সীট থেকে তুলল। ফ্রেঞ্চ যুবক, হেনরির দায়িত্বে ছেড়ে দেয়া হলো মহিলাকে। মহিলাকে নিয়ে ফ্লাইট ডেকের দিকে চলে গেল হেনরি।
ডাক্তারের দিকে না তাকিয়ে ক্যারেনের দিকে ফিরল ইনগ্রিড। বাচ্চাদের বাছাই কর-একটা ছেলে আর একটা মেয়ে, নির্দেশ দিল সে। আর হ্যাঁ, গর্ভবতী মেয়েলোকটাকেও। ওর অত বড় পেটটা দেখুক ওরা।
দুর্ভাগা জিম্মিদের খেদিয় ফরওয়ার্ড গ্যালিতে নিয়ে গেল ক্যারেন, পিস্তলের মুখে বসিয়ে রাখল ভাজ করা এয়ার-ক্রুদের চেয়ারে। ফ্লাইট ডেকের দরজা খোলা, গ্যালি থেকে ইনগ্রিডের গলা পরিষ্কার শুনতে পাওয়া গেল, হেনরিকে বলছে, ডেডলাইন পেরোবার সাথে সাথে আমাদের নিষ্ঠুরতার নমুনা দেখানোটা ভয়ানক জরুরি। দেখাতে যদি আমরা ব্যর্থ হই, ওরা আমাদের টোড়া সাপ ধরে নেবে। আমরা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাব। অন্তত একবার ওদেরকে দেখাতে হবে আমরা কতদূর যেতে পারি।
বাচ্চা মেয়েটা কাঁদতে শুরু করল। তেরো বছর বয়স, বিপদটা বুঝতে পারছে। সুলদেহী ডাক্তারের স্ত্রী মেয়েটার কাঁধে হাত রাখল, আদর করে কাছে টানল।
স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো…, হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠল রেডিও, ইনগ্রিডের জন্যে আমাদের একটা মেসেজ আছে।
গো অ্যাহেড, টাওয়ার, দিস ইজ ইনগ্রিড। লাফ দিয়ে মাইক্রোফোন ধরেছে সে, পা লম্বা করে দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে ফ্লাইট ডেকের দরজা।
নেগোশিয়েটর তোমার বিবেচনার জন্যে প্রস্তাব দিতে চায়। কপি করার জন্যে তৈরি হও।
নেগেটিভ, ঠাণ্ডা, নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল ইনগ্রিড। আবার বলছি, নেগেটিভ। নেগোশিয়েটরকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে। আর তাকে বল চল্লিশ মিনিট পর ডেডলাইন। তাড়াতাড়ি এখানে চলে এলে ভালো করবে। মাইক্রোফোনটা হুকে ঝুলিয়ে হেনরির দিকে ফিরল সে। শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা শুরু হয়েছে-এবার আমরা পিল নিতে পারি।