ইনগ্রিডের সামর্থের যেন কোনো শেষ নেই। রাতেরবেলায় যাত্রীদের আসনের মাঝের আইল ধরে হেঁটে চলে সে, দু-একটা নরম কথা বলে সান্ত্বনা দেয় রাতজাগা যাত্রীদের।
আগামীকাল সকালে আমাদের দাবির একটা উত্তর পাব, সমস্ত নারী এবং শিশুদের মুক্তি দেয়া হবে। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে-কোনো চিন্তা করবেন না।
মধ্যরাতের কিছু পরে, ককপিটে তাকে ডেকে নিল ডাক্তার ভদ্রলোক।
নেভিগেটর বেচারার অবস্থা মারাত্মক, জানাল সে, এখনই ওকে কোনো হাসপাতালে নিতে না পারলে বাঁচানো যাবে না।
এক পা পিছিয়ে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ইনগ্রিড। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে বেচারা, দ্রুত শ্বাস পড়ছে।
কিডনি অকেজো হয়ে গেছে, জানাল ডাক্তার, শ পেয়ে দুটো কিডনিই। বিকল হয়ে গেছে। এখানে কোনো চিকিৎসা করা সম্ভব না, হাসাপাতাল ছাড়া উপায় নেই।
অর্ধ-সচেতন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের একটা হাত তুলে নেয় ইনগ্রিড; দুঃখিত। সেটা সম্ভব নয়।
আরো কিছুক্ষণ আহতের হাত ধরে বসে রইল সে।
তোমার কি অনুভূতি বলে কিছু নেই? তিক্ত স্বরে জানতে চায় ডাক্তার।
মানবজাতীর প্রতি যেমন অনুভব করি–ওর প্রতিও আমার দরদ আছে, ইনগ্রিড বলে। কিন্তু ও তো কেবল একটা প্রাণ। এরকম আরো কত প্রাণ রয়েছে বাইরে।
.
দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানীতে প্রায় সারা রাত ধরে কেবিনেট মিটিং চলল। বুল-ডগ আকৃতির মাথা আর দানব আকৃতির দেহ নিয়ে টেবিলের এক মাথায় বেশিরভাগ সময় নিঃশব্দে বসে থাকলেন প্রাইম মিনিস্টার, মাঝেমধ্যে শুধু ঘেৎ ঘোৎ করে অসম্মতি বা অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। তার দুপাশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসেছেন, কথা যা বলার তারাই বললেন। টেবিলের আরেক প্রান্তে বসেছেন ব্রিটেন আর আমেরিকার অ্যামব্যাসাডর, তাদের সামনে রাখা টেলিফোন প্রায়ই বেজে উঠছে, দূতাবাস থেকে সর্বশেষ খবর বা স্ব-স্ব সরকারের কাছ থেকে জরুরি নির্দেশ পাচ্ছেন তারা।
আপনার নিজের সরকার এতদিন টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার কথা বলে এসেছে, অন্যান্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে ওদের সাথে আপোষ করা একদম উচিত হবে না, অথচ আজ আপনারা চাইছেন ওদের সাথে আমরা যেন নরম ব্যবহার করি…।
আমরা জোর করছি না, দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে মার্কিন অ্যামব্যাসাডর কেলি কনস্ট্যাবল বললেন। আমরা শুধু পাবলিক সেন্টিমেন্টের কথা ভেবে একটা আপোষ রফার পরামর্শ দিচ্ছি।
স্পট থেকে অ্যাটলাস জানিয়েছে পাল্টা আঘাত হানলে সাফল্যের সম্ভাবনা আধাআধি, বললেন ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডর স্যার উইলিয়াম। আমার সরকার মনে করে এই ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়।
সুযোগ পেয়ে আবার মুখ খুললেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী, আমাদের সেনা বাহিনির গেরিলা ইউনিট মনে করে তারা আরো সাফল্যের সাথে পাল্টা আঘাত করতে পারবে…
কিন্তু অ্যাটলাসের আন্ডারে যে কমান্ডো টিম দায়িত্বে রয়েছে তারা সম্ভবত দুনিয়ার সেরা ট্রেনিং পাওয়া অ্যান্টি-টেরোরিস্ট গ্রুপ, কেনি কনস্টেবল বললেন, তাকে বাধা দিলেন প্রাইম মিনিস্টার।
এই পর্যায়ে, জেন্টলমেন, আসুন আমরা বরং শান্তিপূর্ণ একটা উপায় খুঁজে বের করি।
আমি একমত, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার। স্যার উইলিয়াম মাথা ঝাঁকালেন।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার, কনস্টেবল বললেন, টেরোরিস্টদের দাবির সাথে মার্কিন দাবির মিল আছে।
স্যার, আপনি কি টেরোরিস্টদের দাবি সম্পর্কে সহানুভূতি প্রকাশ করছেন? সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন প্রাইম মিনিস্টার।
আমি পাবলিক সেন্টিমেন্টের দিকে লক্ষ্য করতে বলি, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকা মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। আপনারা যদি টেরোরিস্টদের কিছু কিছু দাবি মেনে নেন তাহলে আগামী সোমবার জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভেটো দেয়া আমাদের জন্য সহজ হবে।
এটা কি একটা হুমকি, স্যার? আবারও সরাসরি জানতে চাইলেন প্রাইম মিনিস্টার।
না, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, স্রেফ কমনসেন্স। প্রস্তাবটা যদি পাস হয়ে যায়, আপনার দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। সারা দেশে সন্ত্রাসবাদীরা তৎপর হয়ে উঠবে, শুরু হবে রাজনৈতিক হাঙ্গামা-দেশটা সেভিয়েত ইউনিয়নের জন্যে হয়ে উঠবে পাকা ফল। আমার সরকার সেটা হতে দিতে চায় না, চায় না চারশ নিরীহ মানুষকে টেরোরিস্টদের হাতে খুন হতে দিতে। ক্ষীণ একটু হাসলেন কেনি কনস্টেবল।
শান্তিপূর্ণ সমাধান ছাড়া আর বোধহয় কোনো পথ খোলা নেই।
কিন্তু আমার প্রতিরক্ষামন্ত্রী একটা উপায়ের কথা এর মধ্যে ব্যাখ্যা করেছেন!
মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, ব্রিটিশ আর আমেরিকান সরকারকে আগে থেকে না জানিয়ে টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধে যদি কোনো সামরিক ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাহলে ভেটো দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না–আমরা বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের রায়কে শ্রদ্ধা জানাব।
এমনকি অ্যাটাক যদি সফল হয় তবুও?
এমনকি অ্যাটাক সফল হলেও। একটা ব্যাপারে আমরা অটল, পাল্টা আঘাত হানতে হলে একমাত্র অ্যাটলাসের নির্দেশেই তা হানা যেতে পারে। কথা না বাড়িয়ে আসুন না ভেবেচিন্তে দেখি টেরোরিস্টদের কোন দাবিটা মেনে নেয়া যায়।
.
ব্রেকফাস্ট পরিবেশনের সময় নিজে উপস্থিত থাকল ইনগ্রিড। মাথাপিছু এক স্লাইস রুটি, একটা বিস্কিট, মধুর মতো মিষ্টি এক কাপ কফি বরাদ্দ করা হলো। খিদের জ্বালায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে আরোহীরা।