গ্রেনেড খুলে পরীক্ষা করা হয়েছে, বলল সে। এক্সপ্লোসিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সোভিয়েত সি, জে, কমপোজিশন, ফিউজিংটা কোনো ফ্যাকটরির তৈরি। প্রফেশনাল স্টাফ, কাজের জিনিস।
পিটারের ধারণাই ঠিক, মেয়েটা মিথ্যে বলেনি–একটা দিয়েই উড়িয়ে দেয়া যাবে প্লেন।
নামের তালিকা আর বিবৃতি ওয়াশিংটন পাঠানোর জন্যে টেলিপ্রিন্টারে দেয়া হয়েছে, সামনের দিকে ঝুঁকে কেবিন ইন্টারকমের সুইচ অন করল কলিন, মাউথপীসে বলল, লুপটা চালাও-প্রথমে সাউন্ড ছাড়া। তারপর পিটারের দিকে ফিরল। খারাপ খবর আছে, বলেছিলাম না?
ভিডিও করা ছবি মাঝখানের স্ক্রীনে ফুটে উঠল। অবজার্ভেশন পোস্ট থেকে পরিষ্কারভাবে তোলা হয়েছে। শুরু হলো পিটারকে দিয়ে, নগ্ন পিঠ আর কাঁধে উজ্জ্বল রোদ নিয়ে বোয়িংয়ের দিকে দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাচ্ছে ও। হঠাৎ করে বোয়িংয়ের দরজা খুলে গেল, কাছ থেকে ছবি নেয়ার জন্যে ক্যামেরাম্যান তার ক্যামেরা জুম করল।
দুজন পাইলট আর এয়ার হোস্টেস দাঁড়িয়ে রয়েছে দোরগোড়ায়, এ স্থির থেকে আবার জুম করল ক্যামেরা। লেন্সের অ্যাপারচার দ্রুত অ্যাডজাস্ট করা হলো, একপলকের জন্যে মেয়েটার সোনালি মাথা পরিষ্কার দেখা গেল, কিন্তু তারপরই একটু ঘুরে গেল মুখটা, তার কমলা কোষের মতো সুন্দর ঠোঁট জোড়া নড়ে উঠল। কাকে যেন কি বলল ইনগ্রিড, মনে হলো তিনটে শব্দ উচ্চারণ করল সে। তারপর ঘাড় সোজা করে ক্যামেরার দিকে ফিরল।
ওকে, বলল কলিন। আবার চালাও, এবার সাউন্ডে নিউট্রাল ব্যালান্স দিয়ে।
গোটা লুপট আবার চালানো হলো। কেবিনের দরজা খুলল, তিনজন জিম্মিকে দেখা গেল, সোনালি চুল নিয়ে মাথাটা ঘুরল, আর তারপরই ইনগ্রিডের গলা শোনা গেল, লেটস স্লাইড। কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ডে হিস-হিস আর শোঁ-শোঁ আওয়াজ হচ্ছে।
লেটস স্লাইড? জিজ্ঞেস করল পিটার।
আবার চালাও, এবার ডেনসিটি ফিলটার ব্যবহার কর, নির্দেশ দিল কলিন।
সেই একই দৃশ্য ফুটে উঠল স্ক্রীনে, লম্বা ঘাড়ের ওপর সোনালি মাথা ঘুরল।
লেটস স্লাইড। কিন্তু পিটারের মনে হলো পরিষ্কার শুনতে পায়নি ও।
ওকে, টেকনিশিয়ানকে বলল কলিন, এবার ফুল ফিল্টার দাও, ফুল ভলিউমে প্রতিধ্বনি হোক।
একই দৃশ্য, মেয়েটার মাথা সরু ঠোঁট ফাঁক হলো, স্ক্রীনের বাইরে দাঁড়ানো কাউকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল।
এবার শুনতে ভুল হলো না। পরিষ্কার গলায় ইনগ্রিড বলল, ইটস স্ট্রাইড। শোনার সাথে সাথে অদৃশ্য হাতের প্রচণ্ড একটা ঘুসি খেল পিটার তলপেটে।
মেয়েটা তোমাকে চেনে, বলল কলিন। উঁহু, শুধু চেনে বলছি কেন-তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল!
দুজন ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল, পিটারের প্রশস্ত কপালে দুশ্চিন্তার রেখা। অ্যাটলাসের কথা অনেকেই জানে, কিন্তু থোর কমান্ডের অস্তিত্ব হাতে গোণা মাত্র কয়েকজন লোক ছাড়া কেউ জানে না–একেবারেই টপ সিক্রেট। অ্যাটলাসের তিন-চারজন বাদে বাইরের আরো হয়তো পাঁচ-ছয়জন জানতে পারে, তাদের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট একজন। অথচ ইনগ্রিডের কথাগুলো শুনতে ওরা ভুল করেনি।
শান্ত, ঠাণ্ডা গলায় নির্দেশ দিল পিটার, আবার চালাও।
দুটো শব্দের জন্যে উত্তেজনার সাথে অপেক্ষা করে থাকল ওরা, ইনগ্রিডের প্রাণবন্ত কণ্ঠস্বর আবার শোন গেল। ইটস স্ট্রাইড, বলল ইনগ্রিড, তারপর খালি হয়ে গেল স্ক্রীন।
পাতা বন্ধ করে একটা আঙুল দিয়ে চোখ রগড়াল পিটার। মনে পড়তে একটু অবাক হলো হয়তো প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা ঘুমায়নি ও। কিন্তু শারীরিক ক্লান্তি নয়, কেউ বেঈমানী করেছে উপলব্ধি করে বিধ্বস্ত লাগছে নিজেকে।
কেউ থোর কমান্ডের অস্তিত্ব ফাঁস করে দিয়েছে, নরম গলায় বলল কলিন। বোঝাই যাচ্ছে, শক্তিশালী কোনো একটা মহল থেকে মদদ পাচ্ছে আতঙ্কবাদীরা।
হাত নামিয়ে চোখ খুলল পিটার। ডক্টর পার্কারের সাথে এখুনি কথা বলতে হবে, বলল ও। স্ক্রীনে ডক্টর পার্কারের ছবি আসার পর দেখা গেল বেশ বিরক্ত হয়েছেন তিনি।
আমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলছিলাম, পিটার!
ডক্টর পার্কার, দ্রুত বলল পিটার, পরিস্থিতি বদলে গেছে। কন্ডিশন ডেল্টাতে পাল্টা আঘাত হানলে আমাদের সফল হবার সম্ভাবনা কমে গেছে। ফিফটি ফিফটি চান্স, তার বেশি নয়।
আই সী, গভীর সুরে বললেন, ডক্টর পার্কার। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক আছে, প্রেসিডেন্টকে আমি জানাচ্ছি।
.
ইতোমধ্যে ল্যাভেটরির ধারণ ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গেছে, এয়ারকন্ডিশনিং চালু থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি কেবিনে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গন্ধ। খাবার আর পানির বরাদ্দ খুব কম, ক্ষুৎপিপাসায় কাহিল হয়ে পড়েছে আরোহীরা। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বাচ্চাদের, কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে উঠেছে তাদের, বেশিরভাগই ঝিমাচ্ছে। উত্তেজিত হাইজ্যাকারদের চেহারাতেও ক্লান্তির ছাপ ফুটতে শুরু করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের, বিশ্রামের চার ঘণ্টা সময়ের সবটুকু ঘুমাতে পারে না। লাল সুতি শার্টের ভাজ নষ্ট হয়ে গেছ, বগলের কাছে ঘামে ভেজা। চোখগুলো লালচে, অনিশ্চিত মেজাজ।
সন্ধ্যা লাগার পরপরই কালো-চুল ক্যারেন, বয়স্ক একজন আরোহীর ওপর খেপে গেল। টয়লেট থেকে বেরিয়ে নিজের সীটে ফিরতে দেরি করছিল লোকটা। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রুগিণীর মতো তারস্বরে চেঁচাতে লাগল ক্যারেন, শট পিস্তলের ব্যারেল দিয়ে বুড়ো মানুষটার মুখে বারবার আঘাত করল, চোয়াল কেটে বেরিয়ে পড়ল সাদা হাড়। শুধু ইনগ্রিড শান্ত করতে পারল ক্যারেনকে, হাত ধরে পর্দা ঘেরা টুরিস্ট গ্যালিতে নিয়ে চলে গেল তাকে। ওখানে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করল। ইনগ্রিড। এমন করে না, সোনা, আর মাত্র অল্প কিছুক্ষণ, ক্যারেনকে বলল সে, আমরা এতটা সময় পর্যন্ত ঠিক আছি, এই তো আর কিছুক্ষণ পর পিল খেয়ে নিব। কিছুসময়ের মধ্যেই নিজেকে সামলে নেয় ক্যারেন। আবারো, নিজের অবস্থান নেয় প্লেনের পিছনে।