সংখ্যাটা আগেই আন্দাজ করা হয়েছিল, তবে নিশ্চিতভাবে জানাটা জরুরি ছিল। পাইলটের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল পিটার। শর্ত নিয়ে আলোচনা করার আগে, বললও, এবং মানবিক কারণে, তোমার জিম্মিদের সুস্থতা আর আরামের জন্যে কিছু করার আছে কিনা ভাবতে পারি আমরা।
সবাইকে যত্নে রাখা হয়েছে।
খাবার বা পানির দরকার?
মাথাটা পেছনদিকে একটু হেলিয়ে মনের আনন্দে প্রাণ খুলে হাসল ইনগ্রিড। পানির সাথে ল্যাক্সাটিভ মিশিয়ে দেয়ার মতলব, তাই না? তরল ময়লায় যাতে আমাদের হাঁটু ডুবে যায়? গন্ধে পাগল হয়ে বেরিয়ে যাব?।
প্রসঙ্গটা নিয়ে আর আগে বাড়ল না পিটার, অবশ্য ড্রাগ মেশানো খাবার অনেক আগেই তৈরি করে রেখেছে থোর কমান্ডের ডাক্তার। প্লেনে গুলিতে আহত লোক আছে কেউ?
কেউ আহত হয়নি, হাসি থামিয়ে সরাসরি অস্বীকার করল ইনগ্রিড, কিন্তু দুটো আঙুল দিয়ে গোল একটা আকৃতি তৈরি করল ওয়াটকিংস, হা-সূচক ইঙ্গিত। তার সাদা শার্টের আস্তিনে রক্তের শুকনো দাগও দেখতে পেল পিটার। যথেষ্ট হয়েছে, পিটারকে সাবধান করে দিল ইনগ্রিড। আরেকটা প্রশ্ন কর, আলোচনা বাতিল করে দেয়া হবে…
ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি মেনে নিল পিটার। আর কোনো প্রশ্ন নয়।
পরমুহূর্তে ঝড়ের বেগে কঠিন কঠিন শব্দের বৃষ্টি শুরু হলো, এই কমান্ডোর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো নিষ্ঠুর, চণ্ডাল, অমানবিক, নব্য-সাম্রাজ্যবাদী, বর্ণ-বৈষম্যবাদী, বিবেকহীন শোষক, অবৈধ স্বৈরাচারী সরকারকে সমূলে উৎখাত করা, যারা এই সম্পদশালী দেশের বৈধ সন্তানদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী করে রেখেছে, সংখ্যাগুরু কালো শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত করছে এবং সর্বহারা শ্রেণির মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকার করছে।
জনপ্রিয় কথাবার্তা, সন্দেহ নেই, ভাবল পিটার। কে বলবে ওদের উদ্দেশ্য মহৎ নয়? সবার সহানুভূতি আদায়ের জন্যে ভালো একটা ভূমিকা বাছাই করেছে আতঙ্কবাদীরা। দক্ষিণ আফ্রিকা টার্গেট হিসেবে আদর্শ।
পিটার উপলব্ধি করল, দায়িত্ব পালন ওর জন্যে খুব কঠিন হবে।
বিরতিহীন একনাগাড়ে বলে চলেছে মেয়েটা। দীর্ঘ বাক্য, আবেগ ঢালা কাঁপা কাঁপা গলা, সযত্নে চয়ন করা শব্দমালা। তার বলার ভঙ্গিতে ধর্মীয় উন্মাদনার সব রকম লক্ষণ পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠল। কোনো সন্দেহ নেই মেয়েটা ফ্যানাটিক। ধীরে ধীরে গলা চড়ছে, কর্কশ আর তীক্ষ্ণ। সুন্দর মুখাবয়ব বিকৃত হয়ে উঠল, চোখ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে ঘৃণা আর আক্রোশ। মেয়েটা থামার পর পিটার বুঝল, এই মেয়ের পক্ষে অসম্ভব বলে কিছু নেই। উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে পারে, নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে ঘটিয়ে বসতে পারে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড। শিউরে উঠল ও।
কেউ ওরা কথা বলছে না তবে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল মেয়েটার নিঃশ্বাস। তাকে শান্ত হবার জন্যে সময় দিয়ে অপেক্ষা করছে পিটার।
আমাদের প্রথম দাবি, আবার শান্ত গলায় বলল ইনগ্রিড, কড়া চোখে লক্ষ্য করছে সে পিটারকে, আমাদের প্রথম দাবি, এইমাত্র আমি যে বিবৃতিটা দিলাম সেটা ব্রিটিশ, মার্কিন এবং দক্ষিণ আফ্রিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্কে পড়ে শোনাতে হবে। স্থানীয় সন্ধ্যা সাতটায় পড়তে হবে-লস অ্যাঞ্জেলস্, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, আর জোহানেসবার্গ টিভিতে। পিটার জানে, সাংবাদিকদের কল্যাণে রাতারাতি গোটা দুনিয়ায় প্রচার হয়ে যাবে বিবৃতিটা।
খোলা হ্যাচের সামনে ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইনগ্রিড, তার হাতে মোটা একটা এনভেলাপ দেখা গেল। এতে বিবৃতির একটা কপি আছে, আরো আছে নামের একটা তালিকা। একশ উনত্রিশটা নাম, সবাই এই দেশের অবৈধ সরকারের কারাগারে বন্দী। ওরা সবাই এই দেশের সুযোগ্য সন্তান, মহান নেতা। এনভেলাপটা বাতাসে ছুঁড়ে দিল সে, পিটারের পায়ের কাছে পড়ল সেটা।
আমাদের দ্বিতীয় দাবি, আবার বলল ইনগ্রিড। তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের সবাইকে একটা প্লেনে সুস্থ অবস্থায় তুলে দিতে হবে। প্লেনের ব্যবস্থা করবে স্বৈরাচারী সরকার। ওই একই প্লেনে থাকতে হবে এক মিলিয়ন গোল্ড ক্রুগার র্যান্ড কয়েন, তাও এই সরকারকে জোগাড় করতে হবে। মুক্ত রাজনৈতিক নেতারা যেখানে, যে দেশে যেতে চাইবেন সেখানে, সে দেশে তাদের পৌঁছে দিতে হবে। সোনাগুলো তারা ব্যবহার করবে প্রবাসী সরকার গঠনের তহবিল হিসেবে…
ঝুঁকে এনভেলাপটা তুলল পিটার। দ্রুত হিসেব করছে ও। একটা কুগার র্যান্ড মুদ্রার দাম হবে কম করেও একশ সত্তর মার্কিন ডলার। তার মানে আতঙ্কবাদীরা একশ সত্তর মিলিয়ন মার্কিন ডলার দাবি করছে। আরো একটা হিসেব আছে। এক মিলিয়ন ক্রুগারের ওজন হবে চল্লিশ টনের বেশি, ইনগ্রিডকে বলল ও। একটা প্লেনে কিভাবে ভোলা হবে সব?
মেয়েটা ইতস্তত করতে লাগল। সব কিছু ওরা নিখুঁতভাবে প্ল্যান করেনি বুঝতে পেরে মনে মনে খুশি হলো পিটার। ছোট হলেও, একটা ভুল যদি করে থাকে, আরো ভুল করতে থাকতে পারে।
ট্র্যান্সপোর্টের উপযুক্ত ব্যবস্থা অবৈধ সরকারকেই করতে হবে, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল ইনগ্রিড়, মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে উঠেছে সে।
আর কিছু? জিজ্ঞেস করল পিটার। ওর ভোলা কাঁধে গরম ছ্যাকা দিচ্ছে রোদ, পাঁজর বেয়ে ঘামের ধারা নামছে।