লাল চেহারা আরো লাল করে ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দিল কর্নেল, খানিক পর আর্মারড কারগুলো হ্যাঙ্গারের পিছনে অদৃশ্য হতেই আবার মুখ খুলল পিটার।
ওখানে কজন লোকের সময় নষ্ট করছেন আপনি? প্রথমে অবজার্ভেশন ব্যালকনির নিচে পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিকদের দিকে, তারপর সার্ভিস হ্যাঙ্গারের পাশে সার বেঁধে থাকা ছোট ছোট কালো মাথা দিকে আঙুল তুলল ও।
দুশ তিরিশজন…
ডেকে নিন, নির্দেশ দিল পিটার। বোয়িংয়ের ওরা যেন লোকগুলোকে ফিরে আসতে দেখে।
সবাইকে? কর্নেলের চোখে অবিশ্বাস।
সবাইকে, হাসল পিটার! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, প্লিজ।
দ্রুত শিখছে লোকটা, ইতস্তত না করে ওয়াকিটকিটা মুখের সামনে তুলল আবার। প্রথমে দিশেহারা চঞ্চল একটা ভাব দেখা গেল সৈনিকদের মধ্যে, তারপর লাইনবন্দী হয়ে মার্চ শুরু করল সবাই। নিচু পাঁচিলের ওপর স্টিল হেলমেট আর অটোমেটিক রাইফেলের মাজল দেখা গেল।
কিন্তু একটা কথা আপনাকে মানতে হবে, জেনারেল। ওরা পশু, ওদের সাথে আপনি যদি নরম ব্যবহার করেন…।
আরো কি শুনতে হবে জানে পিটার, তাড়াতাড়ি বলল, কিন্তু বন্দুক তাক করে রাখলে ওরা সতর্ক থাকবে। একটু বিশ্রাম নিতে দিন, আত্মবিশ্বাস বাড়ক।
ইতোমধ্যে চোখে আবার বিনকিউলার তুলেছে ও, একজন সৈনিকের দূর-দৃষ্টি নিয়ে থোরের চারজন স্নাইপারের জন্যে জায়গা খুঁজছে। ওদেরকে ব্যবহার করার সম্ভাবনা খুব কম-একই সময়ে শত্রুদের প্রত্যেককে খুন করত পারতে হবে। তবে দুর্লভ একটা সুযোগ এসেও যেতে পারে, এলে প্রস্তুতির অভাবে বিফল হতে চায় না পিটার। একটা রাইফেল রাখা যেতে পারে, ওখান থেকে বোয়িংয়ের পোর্ট ভেন্টিলেটর রয়েছে, ওটা ভেঙে ফেলা যেতে পারে, ওখান থেকে বোয়িংয়ের পোর্ট সাইডটা সম্পূর্ণ কাভার করা যাবে। দুদিক থেকে ফ্লাইট ডেক কাভার করার জন্যে দুটো রাইফেল দরকার হবে। মেইন রানওয়ের কিনারা ধরে গভীর ড্রেন চলে গেছে, সেটার ভেতর দিয়ে ছোট কামরাটায় একজন লোককে পাঠানো সম্ভব–ওই কামরাতেই রয়েছে অ্যাপ্রোচ রাডার আর আই,এল,এস, বীকন। কামরাটা শত্রুপক্ষের পিছন দিকে, ওদিক থেকে তারা গোলাগুলি আশা করবে বলে মনে হয় না।
এয়ারপোর্টের বড়সড় স্কেল ম্যাপের গায়ে ঘন ঘন চোখ বোলাচ্ছে পিটার, সিদ্ধান্তগুলো লিখে রাখছে নোটবুকে। প্রতিটি সিদ্ধান্তের পাশে আলাদা আলাদা স্কেচ এঁকে প্ল্যান তৈরি করল, প্রতিটি প্ল্যানের পাশে লেখা থাকল দুরত্বের চুলচেরা হিসেব, বরাদ্দ করা থাকল টার্গেটে পৌঁছুবার নির্দিষ্ট সময়। অচেনা শত্রু, ভয়হীন, তবু চিন্তা-ভাবনায় তাদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে চায় পিটার।
একটানা একঘণ্টা কঠোর পরিশ্রম করার পর সন্তুষ্ট হলো পিটার। হারকিউলিস এখনো না এসে পৌঁছুলেও, সিদ্ধান্ত আর প্ল্যানগুলো টারমাক স্পর্শ করার চার মিনিটের মধ্যেই তার টিমের লোকজন পজিশন নিতে পারবে।
ম্যাপ থেকে চোখ তুলে সোজা হলো পিটার, চামড়া মোড়া নোটবুকটা বোম খোলা বুক পকেটে ভরে রাখল। চোখে গ্লাস তুলে আরো একবার ধ্যানমগ্ন দৃষ্টিতে দেখল বোয়িংটাকে, চেহারা দেখে বোঝা না গেলেও অদ্ভুত একটা আক্রোশ অনুভব করল ও।
সারা দুনিয়া জুড়ে সন্ত্রাসবাদীদের আলাদা কোনো পরিচয় নেই—ওরা সবাই নিষ্ঠুর, নির্মম, আর বিবেকহীন। দাবি আদায়ের জন্যে নিরীহ মানুষ আর নারী শিশুদের যারা খুন করে পিটারের অভিধানে তারা অমানুষ।
.
মাথা নিচু করে হকারের কেবিনে ঢোকার সময় পিটার দেখল কমিউনিকেশন টেকনিশিয়ানরা টিভির বড় পর্দাটায় কলিন নোবলকে এনে ফেলেছে। সীটে বসে ওপর সারির ডান দিকে স্ক্রীনে তাকাল ও, দক্ষিণ টার্মিনালের প্রায় সবটুকু দেখা যাচ্ছে। স্ক্রীনের ঠিক মাঝখানে বিশাল ঈগলের মতো বসে রয়েছে জিরো-সেভেন জিরো। পাশের স্ক্রীনে আটশো এম.এম, জুম লেন্সের সাহায্যে বোয়িংয়ের ফ্লাইট ডেকের ব্লো আপ ধরে রাখা হয়েছে। খুঁটিনাটি সবকিছু এত পরিষ্কার যে উইন্ডশিল্ড ঢাকা কম্বলের গায়ে সেলাই করা ট্যাগটা পর্যন্ত দেখতে পেল। তৃতীয় ছোট স্ক্রীনে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের ভেতরটা ফুটে রয়েছে। আস্তিন গোটানো কন্ট্রোলারকে দেখা গেল, সামনে রাড়ার রিপিটার নিয়ে বসে আছে। আরো সামনে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত লম্বা জানালা, জানালার বাইরে বোয়িং। ছবিগুলো তোলা হচ্ছে এক ঘণ্টা আগে টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে বসানো ক্যামেরার সাহায্যে। অবশিষ্ট টিভির স্ক্রীনটা খালি। মেইন স্ক্রীনে হাসিখুশি কলিন নোবলস চুরুট ফুকছে।
চলে এসো হে, মুচকি হেসে বলল পিটার। এখানে তোমার অনেক কাজ।
এত তাড়া কিসের, স্যার? পার্টি তো এখনো শুরুই হয়নি। বেসবল ক্যাপটা ঠেলে মাথার পিছন দিকে সরিয়ে দিল কলিন।
তা ঠিক, এমনকি পার্টিটা কে দিচ্ছে তাও এখনো জানি না আমরা। শেষ হিসেবটা বল, কখন পৌঁছাবে?
অনুকূল বাতাস পাওয়া গেছে–আর মাত্র এক ঘন্টা বিশ মিনিট উড়তে হবে।
গুড, এবার তাহলে কাজ শুরু করা যাক। বুকপকেট থেকে নোটবুক বের করে ব্রিফিং শুরু করল পিটার। বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে মনে করলে ক্যামেরাম্যানকে নির্দেশ দিল ও, স্ক্রীনে বদলে যেতে লাগল দৃশ্যগুলো-কখনো জুম করল ক্যামেরা, কখনো প্যান। ছবিগুলো শুধু কমান্ড কনসোলে নয়, বহু দূর হারকিউলিসের স্ক্রীনেও ফুটল। টীমের লোকজন সবাই যে যার পজিশন আগেভাগে দেখে নিতে পারছে। একই ফটো মহাশূন্যে ঘুরতে থাকা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে, একটু ঝাপসা হয়ে, পৌঁছে যাচ্ছে অ্যাটলাস কমিটির স্ক্রীনে। বুড়ো সিংহের মতো জড়োসড়ো হয়ে ব্রিফিংয়ের প্রতিটি শব্দ গভীর মনোযোগের সাথে শুনছেন ডক্টর পার্কার, একবার শুধু তার অ্যাসিস্ট্যান্ট টেলেক্স মেসেজ নিয়ে এলে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ব্রিফিং শেষ হবার আগেই পিটারের ছবির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকালেন তিনি, নির্দেশ দিলেন তার নিজের ছবি যেন পিটারের কমান্ড কনসোলে ফুটে ওঠে।