প্রথম দুটো লাল রঙের ফোল্ডার দুজন অ্যামব্যাসাডরের। হাইয়েস্ট সিকিউরিটি রেটিং-এর জন্যে ওদের ফোল্ডারের রঙ লাল। ফাইল দুটোর গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে–হেডস অভ দি ডিপার্টমেন্টস ওনলি। পরের চারটে ফোল্ডার দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের কেবিনেট মন্ত্রীদের, ইমার্জেন্সির সময় চারজনই তারা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এবং অধিকার ভোগ করেন। চারটের মধ্যে সবচেয়ে মোটাটা প্রাইম মিনিস্টারের। ডক্টর পার্কার জানেন, এই ভদ্রলোক কালোদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল, তিনি তাদের অনেক ন্যায্য দাবিই মেনে নিতে চান, কিন্তু তার শ্বেতাঙ্গ মন্ত্রীদের প্রবল বিরোধিতার মুখে বেশিরভাগ সময় সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হন। বাকি তিনটে ফোল্ডার বিচারমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, আর কমিশনার অভ পুলিশের।
একেবারে নিচের ফোল্ডারটার রঙও লাল। এত বেশি নাড়াচাড়া করা হয়েছে ওটা যে কার্ডবোর্ড কাভারের কোণগুলো নরম হয়ে গেছে। এই ফোল্ডারের অরিজিনাল প্রিন্ট-আউট চাওয়া হয়েছিল মাস কয়েক আগে, তার পর থেকে পনেরো দিন অন্তত অন্তর লেটেস্ট প্রিন্ট-আউট ভরা হয়েছে। ফোল্ডারের গায়ে লেখা রয়েছে—স্ট্রাইড পিটার চার্লস। তার ঠিক নিচেই ব্র্যাকেটের ভেতর লেখা—হেড অভ অ্যাটলাস অনলি।
ফোল্ডারের লেখাগুলো মুখস্থ বলতে পারবেন ডক্টর পার্কার, তবু রিবন খুলে ফোল্ডারের পাতা ওল্টালেন। পড়তে পড়তেই পাইপে অগ্নিসংযোগ করলেন তিনি।
১৯৩৯ সালে জন্ম পিটারের, সামরিক পরিবারে। বাবা মারা যান ওর জন্মের ঠিক তিন বছরের মাথায়, উত্তর আফ্রিকায় জেনারেল রোমেলের বাহিনির সঙ্গে সংঘর্ষে। ওর জমজ ভাই উত্তরাধিকারসূত্রে ব্যারন হয়; পারিবারিক সুবাদে বহু দেশ ঘুরেছে সে। অন্য সবার সাথে পিটারের একমাত্র অমিল বলতে লেখাপড়ায় তার অসাধারণ মেধা। দলগত খেলাধুলোর চেয়ে একাই যেন থাকতে ভালোবাসে পিটার।
এক মুহূর্তের জন্যে চিন্তা করলেন কিংস্টোন পার্কার। পিটারের চরিত্রের এই ব্যাপারগুলোয় তাকে সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে।
পিটার স্ট্রাইড যখন বাপের রেজিমেন্টে যোগ দেয়, ওর নিষ্ঠা এবং নিয়মানুবর্তিতায় দারুণ অবাক হয় নিকটজনেরা। পিটারের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা জলাঞ্জলি দিয়ে সেনাবাহিনীতে দারুণ সফল হয় সে। গোল বাধে যখন ওর বাহিনিকে সাইপ্রাসে প্রেরণ করা হয়। ওখানকার কমান্ডার তাকে সহ-নেতৃত্ব দিয়ে দেন পিটারের দ্রুত কর্মপদ্ধতির প্রেমে পড়ে। সম্ভবত, ওর মধ্যে তিনিই প্রথম অসাধারণ সম্ভাবনার আভাস পেয়েছিলেন।
অন্তত একবার হলেও যুক্তিযুক্ত সিন্ধান্ত নিয়েছিল সেনা বাহিনি। গত ষোলো বছরে একটি মাত্র ভুলও করেনি স্ট্রাইড; কেবল বিয়েটা ছাড়া–কেবল মাত্র দুই বছরই টিকেছিল ওটা। সাইপ্রাস সফরের পর থেকেই তরতর করে উঠে গেছে তার ক্যারিয়ার, যদিও স্বাভাবিক উপায়ে নয়।
প্রায় বারোটি অসম্ভব কঠিন এবং বিচিত্র অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছিল সে এর পরে; একের পর এক নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে চলছিল সেগুলোতে। ব্রিটিশ রেজিমেন্টের ধারার বিপরীতে নিজের র্যাঙ্ক দ্রুত বাড়াতে সক্ষম হয় পিটার।
ন্যাটোতে শক্তিশালী বন্ধু-বান্ধব আছে তার, আটলান্টিকের দুই পারেই রয়েছে সমর্থন। ব্রাসেলসে ত্রিশ বছর টার্ম শেষ হবার পর মেজর জেনারেল পদে প্রতিষ্ঠিত হয় পিটার স্ট্রাইড। আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের প্রধান নিযুক্ত করা হয় তাকে।
ব্রিটেনে আইরিশ সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন হামলা কমিয়ে আনার পিছনে তার একক অবদান রয়েছে। অ্যাটলাস গঠন করা হবে, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পরপরই প্রজেক্টের প্রধান হিসেবে তার নাম ছিল তালিকায়। কমিটিতে মার্কিন এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি ছিল, যে যার উৎস থেকে পিটার সম্পর্কে যা জানার সবই জানত তারা, নামটা প্রস্তাব করার ব্যাপারে যার যার সরকারের অনুমতিও পেয়েছিল।
প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল অ্যাটলাস কমিটির প্রেসিডেন্ট হবার প্রস্তাব দেয়া হবে পিটারকে, কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে তার সৈনিক পরিচয় এহেন নাজুক একটা সংস্থার সভাপতি হিসেবে সমস্যা তৈরি করে ফেলে।
অ্যাশট্রেতে পাইপের তামাক ঝেড়ে ফোল্ডার হাতে চেয়ার ছাড়লেন ডক্টর পার্কার, পিয়ানোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে গোটা ঘটনাটা স্মরণ করলেন তিনি। পিয়ানোর মিউজিক র্যাকে ফোল্ডারটা রাখলেন, ধীরেসুস্থে বসলেন কীবোর্ডের সামনে। খোলা ফোল্ডারে চোখ রেখে বাজানো শুরু করলেন তিনি।
ডক্টর পার্কার ব্যক্তিগতভাবে থোর কমান্ডেও চাননি পিটারকে, কারণ প্রথম থেকেই পিটারকে তার ভয়ানক বিপজ্জনক বলে মনে হয়েছিল। পিটার অতি মাত্রায় স্বাধীনচেতা, তাকে বশ করা বা বাধ্য করা কঠিন হবে। তার বিবেচনায় থোর কমান্ডের জন্যে আদর্শ কমান্ডার হতে পারত ট্যানার, এখন যে মারকারি কমান্ডের কমান্ডার। কিংবা কলিন নোবলস্ হলেও ভালো হতো।
পিটার থোর কমান্ডের দায়িত্ব নিতে রাজি হলো। অগত্যা বাধ্য হয়ে ওকে মেনে নিলেন ডক্টর পার্কার। মেনে নিলেও, তার মনে খুঁতখুঁতে একটা ভাব থেকেই গেল। পিটারের অ্যামবিশন সম্পর্কে সন্দেহ জাগল তাঁর মনে। ওর ওপর তিনি তীক্ষ্ণ নজর রাখতে শুরু করলেন। পাঁচ পাঁচবার পিটারকে ওয়াশিংটনে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি, সঙ্গে রেখে বুঝতে চেষ্টা করেছেন ওকে। এমনকি তিনি তার নিউ ইয়র্কের বাড়িতেও পিটারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, পুরো একটা রোববার কাটিয়েছেন ওর সাথে।