.
ডানদিকে, শান্তভাবে বলল ইনগ্রিড, পরমুহূর্তে ঘাস মোড়া মাটি ছেড়ে ট্যাক্সিওয়েতে উঠে পড়ল বোয়িং। প্লেনটার ল্যান্ডিং গিয়ার অক্ষত রয়েছে, সাবলীলভাবে ঘুরছে সবগুলো চাকা।
মাটিতে নামা কোনো জাম্বো জেটের ফ্লাইট ডেকে আগে কখনো থাকেনি মেয়েটা, ককপিট মাটি থেকে এতটা উঁচু দেখে বিস্মিত হলো সে, সেই সাথে অসহায় আর বিচ্ছিন্ন একটা অনুভূতি জাগল মনে। আবার বাঁ দিকে, নির্দেশ দিল সে। ঘুরে গিয়ে মেইন এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের দিকে পিছন ফিরল বোয়িং, দক্ষিণ প্রান্তে রানওয়ের শেষ মাথার দিকে এগোল। এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের সমতল ছাদে প্রান্তে রানওয়ের শেষ মাথার দিকে এগোল। এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের সমতল ছাদে অবজারভেশন ডেক, ইতোমধ্যে ডেকটা কৌতূহলী দর্শকে ভরে গেছে। তবে অ্যাপ্রনের সমস্ত তৎপরতা থামিয়ে দেয়া হয়েছে। টেন্ডার আর অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে চলে গেছে সবাই, গোটা রানওয়েতে একজন লোকও নেই।
ওখানে পার্ক করুন। হাত তুলে ফাঁকা একটা জায়গা দেখাল ইনগ্রিড, কাছে বিল্ডিংটা থেকে চারশ গজ দূরে, টার্মিনাল আর সার্ভিস হ্যাঙ্গারের মাঝখানের। হ্যাঙ্গারের পাশে মেইন ফুয়েল ডিপো রয়েছে। ইন্টারসেকশনে থামাবেন।
গম্ভীর এবং চুপচাপ, শুধু নির্দেশ মেনে যাচ্ছে ক্যাপটেন। হঠাৎ সীটের ওপর একটু ঘুরে বসল সে। ওকে এ অবস্থায় ফেলে রাখা যায় না, একটা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে পাঠিয়ে দেয়া দরকার।
কো-পাইলট আর একজন স্টয়ার্ডেস ধরাধরি করে গ্যালির মেঝেতে শুইয়ে দিয়েছে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারকে, ফ্লাইট ডেকের দরজার ঠিক সামনে। রক্ত বন্ধ করার জন্যে টেবিল ন্যাপকিন দিয়ে ক্ষতটা বেঁধেছে ওরা। তাজা রক্ত আর ঘামের সাথে বাতাসে এখনো মিশে রয়েছে বারুদের গন্ধ।
এই প্লেন থেকে কেউ কোথাও যাচ্ছে না। মাথা নাড়ল ইনগ্রিড। এরই মধ্যে আমাদের সম্পর্কে অনেক বেশি জেনে ফেলেছে ও।
এ কি শোনালে, ঈশ্বর! কিন্তু ওর চিকিৎসা দরকার।
চিকিৎসার অভাব হবে না, হেসে উঠে বলল ইনগ্রিডতিনশ ডাক্তার রয়েছে। প্লেনে। দুনিয়ার সেরা ওরা, তাই না? দুজন চলে আসতে পারে, দেখে যাক ওকে। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের রক্তাক্ত ডেস্কের কিনারায় বসে পা ঝুলিয়ে দিল সে, হাত বাড়িয়ে এক ঝটকায় অন করল ইন্টারন্যাল মাইক্রোফোন। রাগের মধ্যেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করল সিরিল ওয়াটকিংস, মেয়েটার দ্বিধাহীন আচরণ একটা জিনিসই প্রমাণ করে, জটিল কমিনিকেশন ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা আছে তার। বুদ্ধি তো রাখেই, ভালো ট্রেনিংও পেয়েছে।
লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, আমরা জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছি। এখানে আমরা অনেকক্ষণ থাকব-হতে পারে কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ। সময় যত গড়াবে ততই আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ব এবং আমাদের ধৈর্য ফুরিয়ে আসবে, কাজেই আপনাদের আমি সতর্ক করে দিয়ে বলছি, যে কোনো রকম অবাধ্যতা কঠোরভাবে দমন করা হবে। এরই মধ্যে আমাদের কাজে একবার বাধা দেয়া হয়েছে, ফলে গুলি খেতে হয়েছে ক্রুদের একজনকে। আঘাত গুরুতর, মারা যেতে পারে। এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটুক, আমরা তা চাই না। কিন্তু সেই সাথে আপনাদের জানা দরকার যে আমি বা আমার অফিসাররা গুলি করতে ইতস্তত করব না, এমনকি আপনাদের মাথার ওপর গ্রেনেডগুলোও ফাটিয়ে দিতে পারি–যদি প্রয়োজন হয়।
থামল ইনগ্রিড, নির্বাচিত দুজন ডাক্তারকে এগিয়ে আসতে দেখল সে। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দুপাশে হাঁটু গেড়ে বসল তারা। থরথর করে কাঁপছে ইঞ্জিনিয়ার, সাদা শার্ট তাজা রক্তে ভিজে জবজব করছে। ইনগ্রিডের চেহারায় কোনো দয়া বা সহানুভূতি নেই, আবার যখন কথা বলল কণ্ঠস্বর আগের মতোই শান্ত এবং হালকা শোনাল। আমার দুজন অফিসার প্যাসেজ ধরে এগোবে, আপনাদের পাসপোর্টগুলো সংগ্রহ করবে তারা। যে যার পাসপোর্ট বের করে রাখুন, প্লিজ।
ঝট করে আড়চোখে দূরে তাকাল সে, চোখের কোণে কি যেন নড়তে দেখেছে। সার্ভিস হ্যাঙ্গারগুলোর পিছন থেকে এক লাইনে চারটে আমার কার বেরিয়ে এল। ফ্রেঞ্চ প্যানহার্ড ওগুলো, এখানে সংযোজন করা হয়েছে। হিঁচড়ে টানার উপযোগী লম্বা টায়ার, গর্তের ভেতর সচল কামান বসানোর মঞ্চ, কামানের লম্বা ব্যারেল, সব পরিষ্কার দেখা গেল। ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেল ইনগ্রিডের, ওদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। সাবধানে ঘুরল আর্মার ভেহিকেলগুলো, বোয়িং থেকে তিনশ গজ দূরে দাঁড়াল চারটে পয়েন্টে-প্লেনের ডানা বরাবর দুটো, একটা লেজের দিকে, অপরটা নাকের সামনে–ঘেরাও করে ফেলল জিরো সেভেন-জিরোকে, লম্বা কামানের ব্যারেলগুলো প্লেনের দিকে তাক করা।
সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ইনগ্রিড, তার দিকে এগিয়ে এল একজন ডাক্তার। ছোটখাটো মানুষটা, মাথায় উঁকি দিচ্ছে টাক, খুব সাহসী।
ওকে এই মুহূর্তে হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
সে প্রশ্নই ওঠে না।
এটা একটা মানবিক প্রশ্ন, লোকটার জীবন বিপন্ন।
জীবন আমাদের সবার বিপন্ন, ডাক্তার। এক মুহূর্ত থেমে কথাটা হজম করার সময় দিল ইনগ্রিড। কি কি দরকার আপনার তার একটা তালিকা দিন আমাকে। চেষ্টা করে দেখতে পারি পান কিনা।
.
ল্যান্ড করার পর মোলো ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, অথচ মাত্র একবার যোগাযোগ করেছে ওরা। জ্যাকেট খুলে ফেলেছেন ডক্টর পার্কার, ঢিল করেছেন টাইয়ের নট, বাকি আর কিছু দেখে বোঝার উপায় নেই রাত জাগার ক্লান্তি তাকে স্পর্শ করেছে। মাত্র একবার যোগাযোগ করে দুটো অনুরোধ করেছে সন্ত্রাসবাদীরা–ইলেকট্রিক মেইন্স-এর সাথে পাওয়ার লিঙ্ক-আপ আর মেডিকেল সাপ্লাই চেয়েছে।