রোটরের তলা থেকে বেরিয়ে এসে সিধে হলেন ডক্টর কিংস্টোন পার্কার, আর এই প্রথম গুহামুখের সামনে পিটারকে দেখতে পেলেন। দাড়িটা নেই, সাথে সাথে পিটারকে চিনতে পারলেন তিনি।
সেই মুহূর্তে খাঁচার বন্দি সিংহের মতো লাগল ডক্টর পার্কারকে।
খলিফা! কর্কশ কণ্ঠে ডাকল পিটার, পরমুহূর্তে ডক্টর পার্কার চরকির মতো আধ পাক ঘুরে যেতে ওর সমস্ত সন্দেহের অবসান হলো। বিশাল ধড় নিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে ছুটলেন ডক্টর পার্কার, চোখের নিমেষে পৌঁছে গেলেন কেবিন দরজার সামনে।
ব্রাউনিং ধরা হাত তুলেই গুলি করল পিটার। সময় নিয়ে লক্ষ্যস্থির করেনি, তবে লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হলো না। প্রথম গুলিটা পিঠে লাগল, খোলা দরজা দিয়ে কেবিনের ভেতর ছিটকে পড়লেন ডক্টর পার্কার। ঠিক পিঠে নয়, কোমরে লেগেছে গুলিটা, বুঝতে পারল পিটার–মৃত্যু হবে না। হঠাৎ পরাজয়ের গ্লানি গ্রাস করতে উদ্যত হলো ওকে। হেলিকপ্টার উঠান ছেড়ে শূন্যে উঠে যাচ্ছে। খাড়াভাবে উঠছে, সেই সাথে ঘুরে যাচ্ছে দ্রুত।
এক ছুটে বিশ ফিট পেরোল পিটার, লাফ দিয়ে প্যারাপেটের মাথায় চড়ল। ওর মাথার ওপর দিয়ে সগর্জনে চলে যাচ্ছে জেট র্যাঞ্জার, পেটটা মানুষখেকো হাঙরের মতো সাদা লাইটের, ল্যান্ডিং আলো ধাধিয়ে দিল ওর চোখ। দুর্গ-প্রাচীরের ওপর দিয়ে উড়ে গেল যান্ত্রিক ফড়িং।
প্রাচীরে দাঁড়িয়ে দুহাতে ধরল পিটার ব্রাউনিংটা। সরাসরি ওপর দিকে গুলি করছে ও। ফুয়েল ট্যাংক কোথায় জানা আছে ওর। পিস্তল থেকে এক এক করে বেরিয়ে গেল কয়েকটা বুলেট, প্রতিবার কাঁধে ঝাঁকি খেল পিটার।
কপ্টারের পেট কামড়াল ভেলেক্স বুলেট, বিস্ফোরিত হয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। তবু নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে জেট র্যাঞ্জার। গুনছিল পিটার, ব্রাউনিং খালি হয়ে এসেছে।
সাতটা, আটটা-এই সময় হঠাৎ মাথার ওপর আকাশটা আগুনে ভরাট হয়ে গেল। হুস করে প্রচণ্ড একটা আওয়াজ হলো, দুর্গ প্রাচীরে কেপে উঠল পিটারের পা। শূন্যে চিৎ হলো জেট র্যাঞ্জার, ওটাকে মুড়ে ফেলেছে আগুন। তারপর ডিগবাজি খেতে শুরু করল, আগুনের গোলাটা সবেগে নেমে গেল গভীর খাদের দিকে।
উঠানের দিকে ঘুরছে পিটার, চোখের কোণ দিয়ে দেখল কাঠের দরজা দিয়ে উঠানে বেরিয়ে আসছে লোকজন।
ওরা সবাই থোর কমান্ডের কমান্ডো, ট্রেনিং পাওয়া দক্ষ যোদ্ধা, ওদের নিজ হাঁটে ট্রেনিং দিয়েছে পিটার। তবু উঠানে ঢোকার কাঠের দরজার দিকেই ছুটল ও, পালাবার ওটাই একমাত্র পথ।
তীব্র আলো আর যান্ত্রিক গর্জন, পিটারের পিছন দিক থেকে আসছে। কোনো সন্দেহ নেই, সবশেষে উদয় হতে যাচ্ছে মোসাড, ভাবল পিটার। দুর্গ প্রাচীর ধরে ঝড়ের বেগে ছুটছে ও।
বুলেট বৃষ্টি শুরু হলো এক সেকেন্ড পর। বাতাসে শিস কেটে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল কয়েকটা। প্যারাপেট ধরে ছুটতে ছুটতেই শেষ বুলেটটা উঠানে দাঁড়ানো লোকগুলোকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ল পিটার। পরমুহূর্তে ধাক্কা খেল, ওর শার্টের আস্তিন ধরে কে যেন হ্যাচকা টান দিল। দুর্গ-প্রাচীরের কিনারা থেকে পড়ে গেল পিটার।
পতনটা অনন্তকাল স্থায়ী হবে, উপলব্ধি করে চোখ বুজল পিটার। গলার ভেতর থেকে একটা আর্তচিংকার বেরিয়ে আসতে চাইল। এক হাজার কি দেড় হাজার ফিট নিচে খাদের তলা। ধাক্কা খাওয়ার আগেই নিজের মৃত্যু কামনা করল পিটার।
প্যারাপেটের দশ ফিট নিচে সরু, বিশ ইঞ্চি চওড়া কার্নিসে একজোড়া কাঁটাঝোঁপ গজিয়েছে, শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে যেন পিটারকে বিদ্ধ করার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। ঝোঁপের মধ্যে পড়ে দোল খেতে শুরু করল পিটার, মটমট করে ভেঙে গেল কয়েকটা ডাল। ব্লেজার, মোজা, টাইয়ের ভেতর ঢুকে গেছে কাটা, মাংসে কামড় বসাচ্ছে।
অচেতন হওয়ার আগে ও শুনতে পেল, কলিন নোবলস্ চিৎকার করছে, সিজ ফায়ার! কেউ আর গুলি করবে না।
আর তারপর, অন্ধকার ঘিরে ধরল পিটারকে।
.
চেতন-অচেতনের সীমানায় পিটার, নানান কণ্ঠস্বর, টুকরো-টুকরো কথা, নির্দেশ শুনতে পাচ্ছে সে। কিন্তু কোনো মানে করতে পারছে না কিছুর।
এয়ারক্রাফটের হ্যাচওয়ে দিয়ে ওকে টেনে তোলার কথা মনে পড়ে, থোর কমান্ডের আহতদের উপযোগী স্ট্রেচারে করে তোলা হয় তাকে।
ম্যাগডা অল্টম্যানের লিয়ার জেটের স্মৃতিও ওর মনে আছে। কেবিনের ছাদের। হাতে আঁকা ছবি। মাথার উপরে প্লাজমার বোতল। ক্রিস্টাল গ্লাসে রাখা ক্ল্যারেট। ওকে রক্ত দেয়া হচ্ছে। অসম্ভব ক্লান্ত পিটার–কিছুতেই ওর এখন কিছু আসে যায় না। দুদণ্ড ঘুমাতে চায় সে।
পরেরবার চোখ খোলার পর আলোকজ্জ্বল এক করিডোর দেখতে পেল পিটার। ট্রলির গতি অনুভব করতে পারছিল সে।
মাথা কাত করে ম্যাগডার মিষ্টি মুখটা দেখতে পেল পিটার। ওর ট্রলির পাশে পাশে হাঁটছে।
আমি ভালোবাসি, তোমাকে। বলল পিটার, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না ওর মুখ থেকে। ক্লান্তিতে চোখ বুজল পিটার।
ওর অবস্থা কেমন? চমৎকার ফ্রেঞ্চে কেউ একজনের কাছে জানতে চাইল ম্যাগডা। একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর উত্তর দেয়।
একটা বুলেট হৃৎপিণ্ডের খুব কাছে আটকে গেছে। ওটা বের করা জরুরি।
এরপর, পিটারের ভেইনে সুইয়ের একটা খোঁচা। জিষে পেন্টোখালের গন্ধ পেল সে। অল্প সময়ের মধ্যেই ঘোর অন্ধকার নামল চোখে।
খুব ধীরে চেতন জগতে ফিরে এল পিটার। বুকে বাঁধা একটা ব্যান্ডেজ ওর শ্বাসে বাধা দিচ্ছে।