সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো সন্ন্যাসী দল। এখন যখন তাকে চেনে পিটার, জানে, এই ট্রেনিং পাওয়া অকুতোভয় যোদ্ধা কোনো অংশে তার চেয়ে কম যায় না। দুজন কখনো লাগেনি, কিন্তু লাগলে কে জিতবে কে হারবে বলা সত্যিই কঠিন।
তারপর রয়েছে উঠানের পাঁচজন সশস্ত্র লোক। চোখ পিটপিট করে হঠাৎ উপলব্ধি করল পিটার, ওরা ওখানে বেশিক্ষণ থাকবে না। সহজ একটা হিসাব। একান্ত বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্ট ছাড়া আর কারও সামনে নিজের চেহারা প্রকাশ করবে না খলিফা, যদি কেউ দেখে ফেলে তাকে মরতে হবে। পাঁচজনকে সরে যেতে হবে, তবে কাছাকাছি কোথাও অপেক্ষা করবে তারা-সম্ভবত কোনো গুহার ভেতর। হঠাৎ তৎপর হতে একটু সময় লাগবে ওদের।
তাহলে থাকবে শুধু সন্ন্যাসী আর খলিফা। হেলিকপ্টার চড়ে আসছে সে।
শব্দ শুনে পিটারের মনে হলো, এরই মধ্যে সরাসরি মাথার ওপর পৌঁছে গেছে যান্ত্রিক ফড়িং। ঘাড় বাঁকা করে ওপর দিকে তাকিয়ে রয়েছে সন্ন্যাসী! এই প্রথম তাকে অসতর্ক অবস্থায় দেখল পিটার।
ইঞ্জিনের আওয়াজ বদলে গেল, খাড়াভাবে কপ্টার নামাচ্ছে পাইলট। ল্যান্ডিং লাইটের আলোয় মৃদু আলোকিত হয়ে উঠল গুহার ভেতরটা।
রোটরের বাতাস উঠানটাকে ঢেকে দিল ধুলোয়। চোখের সামনে একটা হাত তুলে গুহা মুখের দিকে আরো একটু সরে এল সন্ন্যাসী।
দোরগোড়ায় পৌঁছে ঘাড় ফিরিয়ে পিটারকে একবার দেখল সে। মাত্র এক পলক। তারপর আবার তাকাল উঠানে।
ঠিক এই মুহূর্তটার জন্যে অপেক্ষা করছিল পিটার। ফণা ভোলা কেউটের মতো ছুটে গেল ও। দশ ফিট পেরোতে হবে, সব শব্দ চাপা পড়বে কপ্টারের গর্জনে। লাফ দিল পিটার, আর ঠিক তখনই ওর দিকে তাকাল সন্ন্যাসী।
আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে সন্ন্যাসীর মাথা নিচু হলো, ডাইভ দিয়ে মাঝপথে রয়েছে পিটার-বাধ্য হয়ে টার্গেট বদলাতে হলো ওকে। ভেবেছিল একটাই কোপ মারবে ঘাড়ে যাতে সাথে সাথে মৃত্যু হবে। এখন আর তা সম্ভব নয়। সন্ন্যাসীর ডান কাঁধের ওপর আঘাত হানল ও, যেন বজ্রপাত হলো।
সন্ন্যাসীর ঘাড় আর হাতের জয়েন্টের মাঝখানে কলার-বোন খুঁড়িয়ে গেল, ইঞ্জিনের আওয়াজ সত্ত্বেও পরিষ্কার শব্দ পেল পিটার। বাঁ হাতে শত্রুর অসাড় কনুই খপ করে ধরে হ্যাচকা টানে উপরে তুলল, ভাঙা কলার-বোনের দুই অসমান প্রান্ত কর্কশ শব্দে ঘষা খেল পরস্পরের সাথে। কনুই ছাড়ল না পিটার, শক্ত করে ধরে মোচড়াতে লাগল, ভাঙা হাড় ক্ষুরের মতো মাংস কাটছে। তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল সন্ন্যাসী, কাঁধের অসহ্য ব্যথা কমাবার ব্যর্থ প্রয়াসে কোমরের কাছে ভাঁজ করল শরীরটা।
যেই কোমর ভাঁজ করতে দেখল পিটার, হ্যাচকা টান দিয়ে দেয়ালের দিকে সবেগে ঠেলে দিল তাকে। পাথরের সাথে সংঘর্ষ হলো খুলির, সমতল মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল সন্ন্যাসী।
দ্রুতহাতে তাকে চিৎ করল পিটার, আলখাল্লার ভেতর ডান কবজি ঢুকিয়ে দিল। ভেতরে প্যারাট্রুপার বুট আর থোর কমান্ডের পুরোদস্তুর নীল ওভারঅল পরে আছে লোকটা। ওয়েবিং বেল্টে চকচক করছে ব্রাউনিং হাই-পাওয়ার পয়েন্ট ফরটি ফাইভ পিস্তল। এক ঝটকায় কুইক-রিলিজ হোলস্টার থেকে বের করে নিল পিটার ওটা, বাঁ হাতের ঝাপটা দিয়ে কক করল। জানে, ভেলেক্স এক্সপ্লোসিভ লোড করা আছে।
কলিনের মাথা আর মুখ থেকে উলেন পাগড়ি খসে পড়েছে। চওড়া হাসিখুশি মুখটা এই মুহূর্তে যন্ত্রণায় নীল, ব্রিজের ঠিক নিচে ভাঙা নাকটা আরো যেন বেঁকে রয়েছে। পোড়া চকলেট রঙের চোখজোড়া ভোলা, তবে দৃষ্টি নেই। পিটারের প্রিয় একটা মুখ। এই লোকের কাছ থেকে শ্রদ্ধা আর ভক্তি পেয়েছে ও। কিন্তু কে জানত…।
কলিনের চুলের ভেতর থেকে কপালে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত, তবে এখনো জ্ঞান হারায়নি সে। তার নাকের ব্রিজে ব্রাউনিংয়ের মাজল ঠেকাল পিটার। ভেলেক্স বুলেট তার খুলির মাঝখানটা ফুটো করে বেরিয়ে যাবে। লাফিয়ে পড়ার পর কখন যেন নকল দাড়িটা হারিয়েছে পিটার, কলিনের চোখে দৃষ্টি ফিরে আসতে দেখল ও। ক্ষীণ একটু বিস্ফারিত হলো চোখজোড়া, চিনতে পারছে।
পিটার! না! কলিন মিনতি জানাল, কাতর চোখে প্রাণভিক্ষার আবেদন, আমি ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার!
বিস্ময়ের আঘাত পঙ্গু করে দিল পিটারকে। সেই সাথে বিস্ময়ের একটা ধাক্কাও অনুভব করল পিটার। ব্রাউনিংয়ের ট্রিগারে ছিল হলো ওর আঙুল। ধীরে ধীরে সিধে হলো পিটার, তিন সেকেন্ড একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল কলিনের মুখের দিকে, তারপর অকস্মাৎ তার আহত কাঁধের ওপর ঘাড় লক্ষ্য করে প্রচণ্ড এক লাথি মারল। জ্ঞান হারাল ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার। ঝট করে মাথা নিচু করে গুহার বাইরে বেরিয়ে এল পিটার।
উঠানে নেমেছে হেলিকপ্টার। কিন্তু আকাশে আরো একটা উজ্জ্বল আলো দেখল পিটার। সার্চ লাইট, গভীর খাদের তলায় কি যেন খুঁজছে।
উঠানেরটা বেল জেট র্যাঞ্জার, ফাইভ সিটার, গায়ে থোর কমান্ডের নীল আর সোনালি রঙ করা, বড় বড় হরফে লেখা : থোর কমিউনিকেশনস
কন্ট্রোল সামনে নিয়ে এখনো নিজের সীটে বসে রয়েছে পাইলট, একজন মাত্র আরোহী কেবিন থেকে নেমে এসেছে, দীর্ঘ পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে সে।
মাথার ওপর রোটর ব্লেড ঘুরতে থাকায় ঘাড় নিচু করে আছে সে, তবু তার শালপ্রাংশু দেহ-কাঠামো চিনতে পারল পিটার। মাথাটা প্রকাণ্ড, শরীরের তুলনায় কাধ দুটো একটু বেশি চওড়া। খুলির দুপাশে পাক ধরা সোনালি চুল রোটরের বাতাসে উড়ছে। তাকে আলোকিত করে আছে ল্যান্ডিং লাইটের চোখ ধাঁধানো আলো। কোনো শেক্সপিরিয়ান ট্রাজেডির কেন্দ্রীয় চরিত্র বলে মনে হলো তাকে পিটারের।