সন্তুষ্ট হয়ে পিছিয়ে গেল তারা, প্রথম সন্ন্যাসী আবার পিটারকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। সরু প্যাসেজ খানিক পর পর বাঁক নিয়েছে, প্রতিটি বাঁক গুনছে পিটার। সম্মিলিত কণ্ঠের একটা গুঞ্জন ঢুকল কানে, দূরাগত এবং অস্পষ্ট।
ধীরে ধীরে প্রার্থনার সুর পরিষ্কার হলো। গ্রীক অর্থোডকস্ চার্চের সার্ভিস-রহস্যময়, ভোতা আর কর্কশ লাগল কানে। এই লোমহর্ষক শব্দের সাথে ধূপের ধোয়া মিশে গিয়ে পরিবেশটাকে আরো গা ছমছমে করে তুলেছে। পথ দেখিয়ে পিটারকে একটা বিশাল গুহার ভেতর নিয়ে এল সন্ন্যাসী। আলো এখানে খুব কম, গুহার বিশালত্ব বা লোকজনের সংখ্যা আন্দাজ করা অসম্ভব। যতদূর দেখা গেল, গ্রীক সন্ন্যাসীদের বড় বড় মাথা দেখতে পেল পিটার, লম্বা কাঠের আসনে সার সার মূর্তির মতো প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে আছে। প্রতিটি মুখ প্রাচীন, সাদা দাড়িতে ঢাকা। জ্যান্ত শুধু চোখগুলো, মহামূল্য পাথরের মতো জ্বলছে। ধূপের ঝাঁঝাল গন্ধে শ্বাস নিতে কষ্ট হলো পিটারের। সন্ন্যাসীদের ভেতর দিয়ে হনহন করে এগোল ওরা, কারো মুখে প্রার্থনার একটা শব্দও জড়িয়ে গেল না বা বাদ পড়ল না। কেউ এমনকি ওদের দিকে তাকাল না বা নড়েচড়ে বসল না।
চার্চের পিছন দিকে গাঢ় অন্ধকার, সন্ন্যাসীরা আছে কিন্তু দেখা যায় না। ঘড়ঘড় শব্দ করে পিটারের সামনে একটা প্রাচীন দরজা খুলে গেল। আওয়াজটা লক্ষ্য করে অন্ধকারে পা বাড়াল পিটার। এটা অসম্ভব একটা গোপন দরজা, শুধু সন্ন্যাসীরা জানে।
অন্ধকারে কিছুই দেখার উপায় নেই, হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দিয়ে হাতড়ে এগোল পিটার সাবধানে। ছোট ছোট পাথরে ধাপ ঠেকল পায়ে। সোজা নয়, এঁকেবেঁকে নেমে গেছে সিঁড়িটা। গুনল পিটার, পাঁচশ ধাপ, প্রতিটি ছয় ইঞ্চি উঁচু।
অকস্মাত আরব মরুভূমির হিম-শীতল তারকাখচিত আকাশের নিচে বেরিয়ে এল পিটার। খোলা একটা উঠান, সমতল পাথরের মেঝে। সামনে পাচিলের মতো তাও পাথরের। দুর্গ-প্রাচীরের পর, হাজার, বারো কিংবা পনেরোশ ফিট নিচে উপত্যকা, ঝপ করে নেমে গেছে।
সাক্ষাতের জন্য এর চেয়ে দুর্গম আর সুরক্ষিত জায়গা হতে পারে না। খলিফা যে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্নে মাত্রা ছাড়িয়ে সতর্ক, আরেকবার উপলব্ধি করল পিটার। এখানে আরো সশস্ত্র প্রহরী দেখল ও।
আবার ওরা বিনা নোটিসে পিটারের গা ঘেঁষে এল। দুজন লোক দক্ষ হাতে সার্চ করল ওকে। এই ফাঁকে নিজের চারদিকে ভালো করে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল ও। পাহাড়ের গায়ে উঠানটাকে একটা কার্নিস বলা যেতে পারে, দুর্গ-প্রাচীর পাঁচ ফিট উঁচু। উঠানের দুদিকে পাহাড়ের গা কেটে তৈরি করা হয়েছে গুহা-মুখ, পাশাপাশি অনেকগুলো। সন্ন্যাসীরা যখন নিঃসঙ্গ হতে চায় গুহাগুলো ব্যবহার করে তখন।
উঠানে আরো লোক রয়েছে, মাথা আর মুখ উলেন কাপড় দিয়ে পেঁচানো। তাদের মধ্যে দুজন লোক টর্চলাইটের আলো ফেলছে আকাশে—উজ্জ্বল জোড়া রশি পিরামিডের আকৃতি তৈরি করেছে কালো আকশের গায়ে।
পিটার বুঝল, কোনো প্লেন সঙ্গে দিচ্ছে না ওরা। না, প্লেন হতে পারে না–নিশ্চই হেলিকপ্টার। এই ছোট উঠানে হেলিকপ্টরটাই শুধু নামতে পারবে।
সার্চ করা শেষ হলো, একজন লোক ইঙ্গিতে সামনে এগোতে বলল পিটারকে। প্রকাণ্ডদেহী সন্ন্যাসী একটা গুহা-মুখে ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে অপেক্ষা করছে।
এগিয়ে গিয়ে মাথা নিচু করল পিটার, ঢুকে পড়ল গুহাটার ভেতর। কেরোসিন ল্যাম্পের মৃদু আলায় গুহার অন্ধকার দূর হয়নি। অমসৃণ একটা কাঠের টেবিল রয়েছে এক দিকের দেয়াল ঘেঁষে, টেবিলের ওপর দেয়ালে সাদামাটা একটা ক্রুশ। আর কোথাও কোনো অলংকরণ চোখে পড়ল না। পাথর কেটে খোপ বানানো হয়েছে কয়েকটা, পোকায় কাটা বই আর বাসন-পেয়ালা রাখা হয়েছে। এই গুহাটাও সম্ভবত স্বেচ্ছা-নির্বাসনের জন্যে ব্যবহার করা হয়।
ইঙ্গিতে পিটারকে ভেতরে ঢুকতে বললেও, প্রথমে সন্ন্যাসী গুহামুখের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকল, হাত দুটো ঢোলা আলখাল্লার ভেতর ঢোকানো, মুখ ঘুরে আছে অন্য দিকে।
গুহা বা গুহার বাইরে উঠানে পিন-পতন স্তব্ধতা। তবে ইলেকট্রিসিটির মতো জ্যান্ত আর ধনুকের ছিলার মতো টান টান। কেউ নড়ছে না, সবাই অপেক্ষায়।
আবার হঠাৎ সেই গন্ধটা পেল পিটার। এখানে, এই গুহার ভেতর। সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল, বিস্ময়ের একটা ছোট ধাক্কার মতো, গন্ধটা চিনতে পারার সাথে সাথে। সন্ন্যাসীর কাছ থেকে আসছে।
বিদ্যুৎ চমকের মতো সন্ন্যাসীর পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেল পিটারের কাছে। দীর্ঘ কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে থাকল ও। দিশেহারা মনে হলো নিজেকে।
তারপর দুয়ে দুয়ে চারের মতো খাপে খাপে মিলে গেল প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত সব। জানে, এখন পিটার জানে!
ডাচ চুরুটের সুগন্ধ, এত পরিচিত যে ভোলার মতো নয়। চিনতে এত দেরি হলো সেটাই আশ্চর্য! প্রকাণ্ডদেহী সন্ন্যাসীর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকল পিটার।
বাতাসে এখন মৃদু গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, লণ্ঠনের কাছে যেন পোকাদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। সামান্য একটু কাত করল মাথাটা সন্ন্যাসী, গভীর মনোযোগের সাথে শুনতে চেষ্টা করছে।
বাঁচতে হলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে অঙ্ক কষতে হবে পিটারকে, হিসাবে এক চুল ভুল করা চলবে না।
সন্ন্যাসী প্রতিপক্ষ, উঠানে দাঁড়ানো পাঁচজন সশস্ত্র লোক প্রতিপক্ষ। হেলিকপ্টার আসছে, ওতেও আছে একাধিক শত্রু।