লোকটা যদি মারা যায় সম্পূর্ণ আপনার দোষে মারা যাবে।
আঙুল আর তালুহীন হাতটা যেন আপনা থেকে সেঁটে এল গায়ের সাথে ক্ষতটা পেটে ঠেকিয়ে সামনের দিকে যতটা সম্ভব ঝুঁকল ইঞ্জিনিয়ার, উরু আর পেটের মাঝখানে চাপা পড়ে গেল হাতটা। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুল না, দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা দম ছাড়ার সময় কেঁপে কেঁপে উঠল সারা শরীর, কালচে আর বিকৃত হয়ে উঠেছে মুখ।
বিচ্ছিন্ন হাতটা থেকে দৃষ্টি যেন ছিঁড়ে সরিয়ে আনল ক্যাপটেন ওয়াটকিংস, আবার সামনের দিকে তাকাল। সরু ট্যাক্সিওয়ে আর রানওয়ে মার্কারের মাঝখানে ঘাস মোড়া বিশাল খোলা মাঠ। হাঁটু সমান উঁচু হবে ঘাসগুলো, তবে আন্দাজ করা যায় ঘাসের নিচে মাটি কমবেশি সমতলই হবে।
শান্তভাবে থ্রটল পিছিয়ে আনল ক্যাপটেন, ইঞ্জিনের গর্জন কমে এল, নিচু হলো প্লেনের নাক। মেইন রানওয়ের দিকে এগোচ্ছে বোয়িং, গাড়ির ড্রাইভারদের এখুনি বুঝতে দিতে চায় না তার উদ্দেশ্য। ডাইনী, নিঃশ্বাসের সাথে বিড়বিড় করে বলছে সে। উন্মত্ত কুত্তি!
একেবারে সম্ভাব্য শেষ মুহূর্তে সামান্য দিক বদল করল সে, খোলা মাঠের দিকে তাক করল প্লেনের নাক। একটু পর পিছিয়ে নিয়ে এসে লক করে দিল থ্রটল। ঝাপ্ করে নেমে এল বোয়িং। গতি এর চেয়ে কমে গেলে শূন্যে থেমে যাবে। ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে ঘাসের দিকে নামাতে শুরু করল জিরো-সেভেন জিরোকে।
প্রথম ঝাঁকিটা তেমন জোরাল হলো না, কিন্তু তারপরই বিরতিহীন লাফ দিতে দিতে নিয়ন্ত্রণহীন ধেয়ে চলল জিরো-সেভেন-জিরো। শেষ রক্ষা বোধহয় সম্ভব হলো না, কাত হয়ে পড়ল বোয়িং, উল্টে যায় যায় অবস্থা। শক্ত করে ধরে নোজ হুইলটা এমনভাবে ঘোরাচ্ছে ক্যাপটেন, মনে হচ্ছে প্যানেল থেকে ওটাকে ভেঙে বের করে আনতে চাইছে। ওদিকে তার কো-পাইলট বোয়িংয়ের সবগুলো দৈত্যাকার ইঞ্জিন রিভার্স সুইচ টিপে চালিয়ে দিয়েছে, মেইন ল্যান্ডিং গিয়ার ব্রেকে পা চেপে ধরে প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।
স্টারবোর্ড ডানার ডগা থেকে অল্প দূরে দেখা গেল ফায়ার ইঞ্জিন আর ট্যাংকারগুলোকে, স্যাৎ করে পিছিয়ে গেল। ড্রাইভার আর সহকারীদের একেবারে কাছ থেকে এক পলকের জন্যে দেখা গেল, স্তম্ভিত বিস্ময়ে সবার চেহা সাদাটে হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে কমে এল গতি, নোজ হুইল মাটি স্পর্শ করল। আবার কয়েকটা ঝাঁকি খেল বোয়িং। ইট দিয়ে তৈরি একটা বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি চলে এল সেটা, ওই বিল্ডিংয়ে অ্যাপ্রোচ আর ল্যান্ডিং বীকন বসানো হয়েছে, মেইন রাডার স্থাপনা সহ।
সময় তখন সকাল সাতটা পঁচিশ মিনিট। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো।
.
অবশেষে নামতে পারল ওরা, শান্ত কণ্ঠে বললেন ডক্টর পার্কার, নেমে পড়েছে। এ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল, দক্ষিণ আফ্রিকাই ওদের ফাইনাল ডেসটিনেশন ছিল।
জার্মান স্টাইল, মাথা ঝাঁকাল পিটার। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে ওদের।
দুঃখও হয়, বুঝলে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ডক্টর পার্কার। কেন দুঃখ হয় তা ব্যাখ্যা করার আগে পাইপে দুবার টান দিলেন তিনি। ওরা সবাই একটা নীতিতে বিশ্বাসী-ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে। কোনো বিশেষ মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে নিবেদিতপ্রাণ।
আমি মানি না, স্যার, পিটার দ্বিমত পোষণ করে।
ডক্টর পার্কারের চোখে আগ্রহের ঝিলিক, বিষয়টা নিয়ে পিটারের সাথে তর্ক করতে ভালো লাগছে তার। দাবি আদায়ের আরো অনেক পথ আছে বটে, কিন্তু সেগুলোয় কাজ কতটা হয় তাও ভেবে দেখতে হবে। কাজ হয় না বলেই তো আতঙ্কবাদীরা চরমপন্থা বেছে নিতে বাধ্য হয়। কোনটা সন্ত্রাসবাদ কোনটা নয়, পার্থক্য করা সত্যি খুব কঠিন, তাই না? প্যারিসের রাস্তায় জার্মান অফিসারদের কি হত্যা করা হয় নি?
সেটা যুদ্ধ ছিল। পিটার অটল।
জিরো-সেভেন-জিরো যারা হাইজ্যাক করেছে তারাও সম্ভবত মনে করছে তারা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে।
নিরীহ লোকদের সাথে?
যুদ্ধে জেতাটাই কি বড় কথা নয়? তাছাড়া, সমষ্টির স্বার্থে ব্যক্তির স্বার্থ যদি লঙ্তি হয়, ক্ষতি কি তাতে?
ওদের বোঝা উচিত ভুল পথে রয়েছে ওরা, না বুঝলে তার খেসারত তো দিতেই হবে, বলল পিটার।
কোনটা ভুল পথ, পিটার? হালকা সুরে জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর পার্কার সর্বহারা মানুষের অধিকার আদায়ে যারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতে চায়, তারা ভুল পথে রয়েছে? ধর্মের দোহাই পেড়ে যারা জেহাদ ঘোষণা করেছে অতীতে, তাহলে তাদের কি বলবে তুমি? কেনিয়ার মাও মাও আন্দোলনের কথা না হয় বাদ দাও, বাদ দাও ইদানীং আয়ারল্যান্ডে যা ঘটছে, কিন্তু ফ্রেঞ্চ বিপর্যয়ের সময় যা ঘটেছে তার কি ব্যাখ্যা? তুমি জানো ক্যাথলিক বিশ্বাস প্রচার করার সময় মানুষের ওপর কি নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছিল? নৈতিকতার বিচারের ওগুলোও কি সঠিক ছিল না?
আমি বলব ওগুলো হয়তো যুক্তিগ্রাহ্য ছিল, কিন্তু নিন্দনীয়ও বটে। সন্ত্রাসবাদ নৈতিকতার বিচারে ন্যায্য হতে পারে না, তার ধরন যাই হোক।
অস্বস্তিবোধ করছে পিটার, চেয়ারে নড়েচড়ে বসল। আইনের বাইরে থেকে কোনো প্রতিবাদ হতে পারে না
মানলাম। কিন্তু যাবে না, তারও তো কোনো কথা নেই। আইন তো মানুষই তৈরি করে, নিজেদের সুবিধার খাতিরে। আমি দুঃখিত, পিটার, চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসলেন ডক্টর পার্কার। মাঝেমধ্যে কনফিউজড় হয়ে পড়ি। কিন্তু বুঝতে পারি না যে টেরোরিস্ট হবার চেয়ে দয়াময় উদার হওয়া তোমার-আমার মতো লোকের জন্যে অনেক বেশি নিরাপদ আর সুবিধেজনক। আমাদের মতো নীতি নিয়ে আপোষ করে না ওরা, উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বিধায় ভোগে না। থাক, এবার থামি। পাইপে ঘন ঘন টন দিলেন তিনি। দু-এক ঘণ্টা তোমাকে আর বিরক্ত করব না, নতুন মাত্রা যেটা যোগ হয়েছে সেটা মনে রেখে প্ল্যান তৈরি কর। শেষে শুধু একটা কথা বলি আমার মন বলছে, ব্যাপারটা মেটার আগে বিবেকের কাছে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে আমাদের।