আরো একটা আসছে! আর্তনাদ করে উঠল পাইলট।
আমিও এখানে আছি, হুমকির সুরে বলল ইনগ্রিড, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের ঘাড়ে এত জোরে মাজল চেপে ধরেছে সে যে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বেচারা, কপালটা ঠেকে রয়েছে কমপিউটার কনসোলের কিনারায়। কলারের ওপর নগ্ন ঘাড়ের মান চামড়া ছিলে গেছে, সরু একটা রক্তের ধারা শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে পিঠের দিকে।
মিরেজগুলো একটার পর একটা আক্রমণ চালাল, সুপারসোনিক আলোড়ন বারবার ঝাঁকি দিয়ে গেল জিরো-সেভেন-জিরোকে। গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে খালি হাতে একটা র্যাকের কিনারা ধরে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে ইনগ্রিড, কিন্তু মুহূর্তের জন্যেও ইঞ্জিনিয়ারের ঘাড় থেকে জোড়া মাজ সরাল না। আমার কথার নড়চড় হবে না, বারবার বলল সে। ওকে আমি খুন করব, সত্যি খুন করব। সবাই ওরা আরোহীদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছে, কেবিন আর ককপিটের মাঝখানে বাল্কহেড থাকায় ভোতা আর অস্পষ্ট শোনাল কান্নাগুলো।
এক সময় শেষ মিরেজটাও মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল।
চেষ্টা করে দেখল আর কি, ঠোঁট বাঁকা করে বিদ্রুপের হাসি হাসল ইনগ্রিড, পিছিয়ে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে এক পা সরে গেল সে। আর আসবে না। ইঞ্জিনিয়ার বেচারা মাথাটা কাত করে শার্টের আস্তিন দিয়ে ঘাড়ের রক্ত মুছল। আসবে না, কারণ এখন আমরা ওদের নিয়ন্ত্রিত এয়ারস্পেসের অনেক ভেতরে ঢুকে পড়েছি। হাত লম্বা করে দিয়ে সামনের দিকটা দেখাল সে। দেখ!
মাটি থেকে মাত্র পাঁচ হাজার ফিট ওপরে রয়েছে জিরো-সেভেন-জিরো, কিন্তু হালকা কুয়াশা থাকায় দিগন্তরেখা তেমন স্পষ্ট নয়। ডানদিকে আবছাভাবে একটা টাওয়ার দেখা গেল–ওটা কেম্পটন পার্ক পাওয়ার স্টেশন, কুলিং টাওয়ার। আরো কাছাকাছি বিষাক্ত হলুদ প্রান্ত-সমতল আর নিষ্প্রাণ। খনির সমস্ত আবর্জনা এই প্রান্তরে নিয়ে এসে ফেলা হয়। এই বিশাল এলাকাটাকে বাদ দিয়ে চারধারে ঘন লোকবসতি গড়ে উঠেছে। হাজার হাজার জানালার কাঁচ সকালের রোদ লেগে ঝলসে উঠল।
আরো কাছে লম্বা, সরল, নীলচে বিস্তৃতি দেখা গেল-জান স্মট এয়াপোর্টের মেইন রানওয়ে।
সোজা একুশ নম্বর রানওয়েতে চলুন, নির্দেশ দিল ইনগ্রিড।
অসম্ভব…।
কথা নয়, ধমক দিল মেয়েটা। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল নিশ্চয়ই পরিষ্কার করে রেখেছে সার্কিট। ওরা আমাদের থামাতে পারবে না জানে।
থামাতে পারবে এবং থামাতে যাচ্ছে, জবাব দিল ওয়াটকিংস। রানওয়ে অ্যাপ্রনের দিকে তাকান একবার।
এত কাছে চলে এসেছে ওরা, এক এক করে পাঁচটা ফুয়েল টেন্ডার গোণা গেল, প্রতিটি ট্যাংকে শেল কোম্পানীর প্রতীক চিহ্ন আঁকা রয়েছে।
রানওয়েতে ব্যারিকেড তৈরি করছে ওরা!
শুধু ট্যাংকার নয়, সাথে উজ্জ্বল লাল ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটা আর ধবধবে সাদা দুটো অ্যাম্বুলেন্সও রয়েছে। রানওয়ের কিনারা ধরে ছুটে আসছিল ওগুলো, তারপর মাঝখানের সাদা রেখায় কয়েকশ গজ পর পর দাঁড়িয়ে পড়ল একেকটা গাড়ি।
ল্যান্ড করা সম্ভব নয়, জানিয়ে দিল পাইলট।
অটোমেটিক বাদ দিয়ে হাতে চালান প্লেন, কঠিন আর নিষ্ঠুর হয়ে উঠল ইনগ্রিডের কণ্ঠস্বর। আমার নির্দেশ বদলায়নি। ল্যান্ড করার প্রস্তুতি নিন।
এক হাজার ফিটে নেমে এসেছে বোয়িং, আরো নামছে। একুশ নম্বর রানওয়ের দিকে ছুটছে ওরা। নাক বরাবর সোজা লাল আলোগুলো ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির মাথায় ঘুরছে।
আমাকে মাফ করতে হবে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল ওয়াটকিংস। নামতে চেষ্টা করলে সবাই আমরা যারা পড়ব। তার চেহারায় কোনো ভয় বা দ্বিধা নেই। ওগুলোর ওপর দিয়ে উড়ে এখান থেকে চলে যাব আমি।
ঘাসের ওপর নামুন! মরিয়া হয়ে উঠল ইনগ্রিড। রানওয়ের ডান দিকে খোলা মাঠ, ওখানে নামব আমরা।
সিরিল যেন শুনতেই পায়নি, সামনের দিকে ঝুঁকে ঠেলে সামনে বাড়িতে দিল থ্রটল। আকস্মিক শক্তি পেয়ে গর্জে উঠল ইঞ্জিনগুলো, নাক উঁচু করে তীরবেগে ওপরে উঠতে শুরু করল জিরো-সেভেন-জিরো।
উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার, সারা শরীর উত্তেজনায় আড়ষ্ট। নগ্ন ঘাড়ের ওপর জোড়া মাজলের লালচে দাগ এখনো অম্লান। ডান হাত দিয়ে ডেস্কের কিনারা খামচে ধরল সে, আঙুলের ডগাগুলো সাদা হয়ে গেল।
আড়ষ্ট সেই হাতটার কবজিতে পিস্তলের মাজল চেপে ধরল ইনগ্রিড। কখন সে নড়ল টের পায়নি কেউ। বন্ধ ককপিটের ভেতর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ হলো, মনে হলো কানের পর্দা ছিঁড়ে গেছে। লাফ দিয়ে ইনগ্রিডের মাথার প্রায় কাছাকাছি উঠে এল পিস্তলটা, পোড়া বারুদের গন্ধ ঢুকল নাকে।
চোখ ভরা অবিশ্বাস নিয়ে ডেস্কের ওপর তাকিয়ে থাকল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।
ডেস্কের ধাতব মাথা ভেদ করে গর্ত তৈরি হয়েছে, চায়ের একটা কাপ গলে যাবে, গর্তের কিনারা এবড়োখেবড়ো আর সাদা জরির মতো চকমকে।
বিস্ফোরণে ইঞ্জিনিয়ারের কবজি নিখুঁতভাবে দু-টুকরো হয়ে গেছে, বিচ্ছিন্ন অংশটা সামনের দিকে ছিটকে গিয়ে পাইলটদের জোড়া সীটের মাঝখানে পড়েছে, থ্যাতলানো মাংসের ভেতর থেকে বেরিয়ে রয়েছে ভাঙাচোরা হাড়। পদদলিত, জ্যান্ত, বোবা পোকার মতো মোচড় খাচ্ছে সেটা।
ল্যান্ড! হিসহিস করে বলল মেয়েটা। তা না হলে পরের গুলিটা ওর মাথায় ঢুকবে।
ইউ ব্লাডি মনস্টার! আর্তনাদ করে উঠল সিরিল ওয়াটকিংস, আতঙ্কিত দৃষ্টিতে ইঞ্জিনিয়ারের বিচ্ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।