তার অভিজ্ঞ বন্দুকবাজ চোখে কালো একটা বিন্দুর মতো ধরা পড়ল প্লেনটা। মেঘ আর রোদের মাঝখানে আবছা ধূসর পর্দার গায়ে খুদে একটা পোকা। নিজের অজান্তেই প্লেনের কন্ট্রোল প্যানেলে হাত চলে গেল তার–সরাসরি টার্গেটের দিকে এগোতে চায় না।
প্রতি ঘণ্টায় পনেরোশো মাইল ছুটছে মিরেজ, সামনের কালো বিন্দুটা আশঙ্কাজনক দ্রুতগতিতে বড় হচ্ছে আকারে। খানিক পর টার্গেটের পরিচয় সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ থাকল না। ছড়ানো পাঁচ আঙুলের আকৃতি নিয়ে উড়ছিল ঝাকটা, লীডারের দেখাদেখি বাকি চারটে প্লেনও ঘুড়ির মতো গোত্তা দিয়ে নিচে নামতে শুরু করল। টার্গেট প্লেনের পাঁচ হাজার ফিট ওপরে সিধে হলো মিরেজগুলো।
চিতা, দিস ইজ ডায়মন্ড লিডার-উই আর ভিজুয়াল, অ্যান্ড টার্গেট ইজ এ বোয়িং সেভেন-ফোর-ফোর-সেভেন বেয়ারিং বিটিশ এয়ারওয়েজ মার্কিংস।
ডায়মন্ড লিডার, দিস ইজ চিতা, পাঁচ হাজার ফুট দুরুত্বে থেকে অনুসরণ করুন। রিপোর্ট এগেইন ইন সিক্সটি সেকেন্ডস।
.
মেজর জেনারেল পিটার স্ট্রাইডের একজিকিউটিভ জেট তীরবেগে ছুটে চলেছে দক্ষিণ দিকে, একই দিকে শ্লথগতিতে এগোচ্ছে পেটমোটা ট্রান্সপোর্টটা। প্রতি মুহূর্তে দুটো প্লেনের মাঝখানে দূরত্ব বাড়ছে–জেটটা যখন তার চূড়ান্ত গন্তব্যে। পৌঁছুবে, সম্ভবত এক হাজার মাইল পিছিয়ে থাকবে দ্বিতীয়টা। তবে স্পীড কম হলেও হারকিউলিসের বৈশিষ্ট্য অন্যখানে–পৃথিবীর যে কোনো দুর্গম প্রান্তে, এবড়োখেবড়ো। ছোট্ট স্ট্রিপে লোকজন আর ভারী ইকুইপমেন্ট নিয়ে ল্যান্ড করতে পারে ওটা। হকারের কাজ হলো সন্ত্রাসবাদীরা যেখানে তৎপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পিটারকে সেখানে পৌঁছে দেয়া। আর আগেভাগে পৌঁছে পিটারের কাজ হলো কৌশলে সন্ত্রাসবাদীদের কাছ থেকে সময় আদায় করা, যতক্ষণ অ্যাসল্ট টীম নিয়ে কলিন নোবলস্ না পৌঁছায়।
তবে যোগাযোগ রয়েছে দুজনের মধ্যে, পিটারের সামনে সেন্ট্রাল টেলিভিশনের ছোট স্ক্রীনটা সারাক্ষণ আলোকিত, হারকিউলিসের মেইন হোন্ডের ছবি দেখা যাচ্ছে। তাতে কাছ থেকে চোখ তুললেই নিজের লোকদের দেখতে পাবে পিটার, সবার পরনে থোর ওভারঅল। হাত-পা ছেড়ে দিয়ে শিথিল ভঙ্গিতে বসে আছে সবাই, কারও মধ্যেই আড়ষ্ট কোনো ভাব নেই। এরাও সবাই অপেক্ষার কঠিন পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে বহুবার। সামনের দিকে ছোট একটা ডেস্কের পেছনে বসে রয়েছে কলিন নোবলস, কন্ডিশন চার্লি ঘোষণা করা হলে কি কি কাজ তাৎক্ষণিকভাবে সারতে হবে তার একটা দীর্ঘ তালিকা পরীক্ষা করছে সে। কন্ডিশন ব্রাভোর পর কন্ডিশন চার্লির জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা, সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলে ঘোষণাটা আসবে।
ক্লিক ক্লিক একজোড়া আওয়াজের সাথে সামান্য যান্ত্রিক শব্দ-গুঞ্জন শোনা গেল, পিটারের কমিউনিকেশন কনসোলের সেন্ট্রাল স্ক্রীনটা জ্যান্ত হয়ে উঠল, ডক্টর পার্কারের ছবি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠার আগেই ভেসে এল তার ভারী, গমগমে কণ্ঠস্বর।
কন্ডিশন চার্লি, পিটার, বললেন তিনি। সম্পূর্ণ শান্ত দেখল তাকে পিটার, শিরায় শিরায় দ্রুতগতি পেল রক্তস্রোত, রোমাঞ্চকর শিহরণ বয়ে গেল সারা শরীরে। একজন সৈনিকের জন্যে ব্যাপারটা আনন্দের, এই মুহূর্তটির আশায় বছরের পর বছর অপেক্ষা করে থাকে তারা।
দক্ষিণ আফ্রিকানরা আইডেনটিফাই করেছে জিরো-সেভেন-জিরোকে, বলে চলেছেন ডক্টর পার্কার। প্লেনটা পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড হলো তাদের আকাশসীমায় ঢুকছে।
রেডিও কন্ট্যাক্ট? জিজ্ঞেস করল পিটার।
না। বড়সড় মাথাটা নাড়লেন ডক্টর পার্কার। ডাকাডাকি করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ধরে নিতে হবে টেরোরিস্টদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্লেনটা-কাজেই এখন থেকে এই ডেস্কেই থাকছি আমি যতক্ষণ না একটা বিহিত করা যায়।
কি ধরনের সহযোগিতা আশা করতে পারি আমরা? জিজ্ঞেস করল পিটার।
ইতোমধ্যে বেশ কটা আফ্রিকান রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ করেছি, সম্ভাব্য সব রকম সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে তারা–ওভার-ফ্লাইট, ল্যান্ডিং, রিফুয়েলিং ফ্যাসিলিটি, কোনো সমস্যা হবে না। দক্ষিণ আফ্রিকাও সহযোগিতা করবে। ওদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি আমি।
বলেছি জিরো-সেভেন-জিরোকে যেন ওদের কোনো এয়াপোর্টে নামতে দেয়া না হয়, বললেন ডক্টর পার্কার। দক্ষিণ আফ্রিকায় ল্যান্ডিং ক্লিয়ার্যান্স না পেলে উত্তর দিকে অন্য কোনো দেশে সরে যাবে আতঙ্কবাদীরা, ওদের আসল প্ল্যানও হয়তো তাই। দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে আমার ধারণা কি তুমি জানো, সবকিছুতে গোয়ার্তুমি করা স্বভাব ওদের-তবে এই ব্যাপারটায় ওরা বেশ ভালোই সহযোগিতা করছে।
দেরাজ থেকে কালো একটা ব্রায়ার পাইপ বের করলেন ডক্টর পার্কার, টোবাকো দিয়ে ভরলেন সেটা। শরীরের অন্যান্য অংশের মতে, তার হাত দুটোও মোটাসোটা, তবে আঙুলগুলো অস্বাভাবিক লম্বা আর চঞ্চল। তামাকের গন্ধটা কি রকম মিষ্টি মনে পড়ে গেল পিটারের।
দুজনেই চুপ করে আছে, গভীর চিন্তায় মগ্ন। ডক্টর পার্কারের জোড়া সামান্য একটু কুঁচকে আছে একমনে পাইপ টানছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার তিনি মুখ তুললেন। ঠিক আছে, পিটার–এবার শোনা যাক, তুমি কি ভাবছ?
সদ্য লেখা পয়েন্টগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল পিটার। টেরোরিস্টদের কাছ থেকে সম্ভাব্য চার রকম আচরণ আশা করছি আমরা, ডক্টর পার্কার। যে আচরণই করুক, কিভাবে ওদের আমরা কাবু করব তারও চারটে ছক তৈরি করেছি। আঘাতটা জার্মান নাকি ইটালিয়ান স্টাইলে করবে…।