নেফার চোখ নামিয়ে নরম ও বিষণ্ণ কণ্ঠে উত্তর দিল, বাধ্যবাধকতা, মহানুভব!
তাহলে কখনো তা ভুলবে না, তিনি মাথা নেড়ে ঘুরে চলে গেলেন।
নিজেকে নেফারের প্রত্যাঙ্ক্ষিত ও অবাঞ্ছিত মনে হল। তার চোখ জ্বলছিল এবং উপরের ঠোঁটটা কাঁপতে লাগল। কিন্তু টাইটার চাহনি তাকে শক্ত করল। চোখ কচলে চোখের জল মুছে নিজেকে সহজ করতে সে রথের পাশে ঝুলে থাকা পানির থলে থেকে এক চুমুক পানি খেল। তারপর বৃদ্ধ ম্যাগোস, যার লম্বা দোল খাওয়া কোঁকড়া চুলগুলো ভারি ধুলোয় একাকার হয়ে আছে, তার দিকে ফিরে আদেশের সুরে বলল, আমাকে সেই ভাস্কর্যটা দেখাও, টাটা।
ভগ্ন শহরটির সরু রাস্তায় দাঁড়ানো সারিবদ্ধ রথ, মানুষ ও এলোমেলোভাবে রাখা ঘোড়াগুলোর মধ্যকার খালি স্থানটুকু দিয়ে তারা এগিয়ে চলল। ইতোমধ্যে বিশ জন সৈন্য কাপড় খুলে খালি গায়ে প্রাচীন কূপগুলোর নিচে নেমে পড়েছে; নিচের সামান্য তিতা পানি উপরে তোলার ব্যবস্থা তারা করছিল। একদা এই কূপগুলো নীল ও লোহিত সাগরের বাণিজ্য পথে অবস্থিত একটি সমৃদ্ধশালী জনবহুল এলাকার লোকদের জল যোগান দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিল। তারপর, বহু শতাব্দী পূর্বে, এক ভয়ংকর ভূমিকম্প পানি ধারণের স্তরগুলো উলট-পালট করে দেয়, যার ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। জল তৃষ্ণায় গালালা শহর মৃত্যুবরণ করে। এখন এখানে দুশ ঘোড়ার তৃষ্ণা নিবারণ ও পানির থলেগুলো পূর্ণ করার পক্ষে খুব কমই জল অবশিষ্ট রয়েছে।
যতোক্ষণ পর্যন্ত না তারা পরিত্যক্ত চতুষ্কোণ স্থানটির মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছল, টাইটা নেফারকে সরু গলিটা ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। তারা মন্দির ও রাজপ্রাসাদ অতিক্রম করে এগিয়ে চলল, এখন যা কেবল টিকটিকি আর বিচ্ছুদের আবাসস্থল। ঠিক মাঝ খানে দাঁড়িয়ে আছে লর্ড ট্যানোস এবং দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে তার জয়ের প্রতীক ভাস্কর্যটি, যারা কিনা পৃথিবীর সবচাইতে ধনী ও ক্ষমতাধর জাতিকে প্রায় দমিত করে ফেলেছিল। ভাস্কর্যটি একসাথে জোড়া লাগানো মানুষের খুলির এক অদ্ভুত পিরামিড যা একটা লাল পাথরের পুরু বেষ্টনী দ্বারা সুরক্ষিত। পাথরে খোদাই করা স্তরগুলো যখন সে জোরে জোরে পড়ছিল তখন মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার খুলি তার দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসছে।
আমাদের ছিন্ন মস্তকসমূহ সেই যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে যা এখানে সংগঠিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধে ট্যানোস লর্ড হারাব এর তলোয়ারের নিচে আমাদের মৃত্যু হয়েছিল। এ মহান লর্ডের অমর কীর্তি, যা দেবতাদের মহিমা এবং নীতিবানদের ক্ষমতা থেকে উৎসারিত–সকল প্রজন্ম তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক। এরূপে দেবতা ফারাও ম্যামোসের শাসনামলের চৌদ্দতম বছর স্মরণীয় হয়ে রইল।
রাজপুত্র ভাস্কর্যটির চারপাশ ঘুরে ঘুরে হেঁটে দেখছিল। আর ভালোভাবে সব দেখতে প্রতিটি পদক্ষেপে সে থামছিল। টাইটা ভাস্কর্যটির ছায়ায় আসন পেতে একমনে এসব দেখছিল। যদিও টাইটার অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছিল না তবে তার চোখ দুটো ছিল স্নেহপূর্ণ। বালকটির প্রতি তার বীজ বপন করা অন্য দুটি জীবনে। প্রথমজন হলেন লসট্রিস, মিশরের রাণী। টাইটা ছিল খোঁজা, কিন্তু বয়ঃসন্ধির পরে তাকে খোঁজা করা হয় এবং একদা সে এক মেয়েকে ভালোবাসত। শারীরিক অক্ষমতার কারণে টাইটার ভালোবাসা ছিল পবিত্র এবং এর পুরোটাই সে বিলিয়ে দিয়েছে নেফারের দাদী, রাণী লসট্রিসকে। সে ভালোবাসা এতোই প্রবল যে আজও রাণীর মৃত্যুর বিশ বছর পর তা তার অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে বাস করছে।
অন্য জন যার জন্যে সে নেফারকে ভালোবাসে সে হচ্ছে ট্যানোস, লর্ড হারাব, যার উদ্দেশ্যে এ ভাস্কর্যটি নির্মিত। নিজের ভাইয়ের চাইতেও সে টাইটার কাছে প্রিয় ছিল। তারা দুজনেই আজ চলে গেছেন অসীমে; লসট্রিস এবং ট্যানোস, কিন্তু তাদের রক্তের শক্তিশালী ধারা এ শিশুর শিরায় শিরায় বইছে। অনেক আগে তাদের অবৈধ প্রণয় জন্ম দিয়েছিল যে শিশুটিকে সে হচ্ছে ফারাও ট্যামোস, আজ যে এই রথবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে; রাজপুত্র নেফারের পিতা।
টাটা, আমাকে সেই স্থানটি দেখাও যেখানে তুমি দুসূ দলের সর্দারটিকে কজা করেছিলে, বয়ঃসন্ধি কালের উদ্যম, উজ্জ্বলতা তার কণ্ঠে ঝড়ে পড়ল। এটা কি এখানে? চতুষ্কোণের দক্ষিণ পাশে ভাঙা দেয়ালের দিকে সে ছুটে গেল। আমাকে গল্পটা আবার বল।
না, তা এখানে, এই পাশে, টাইটা দাঁড়িয়ে তার সরু পা দুটো দিয়ে লম্বা পদক্ষেপে পূর্ব পাশের দেয়ালের নিকট এগুতে এগুতে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল। সে ভেঙে পড়া চূড়ারটির দিকে তাকাল। দস্যুটার নাম ছিল শূফতি। সে ছিল এক চোখা এবং প্রভু সেথ-এর ন্যায় কুৎসিত। সে এ দেয়ালের উপর উঠে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল। টাইটা থামল এবং পাথরের টুকরো থেকে একখণ্ড অর্ধ শুকনো মাটির ইট তুলে নিল এবং হঠাৎ উপরের দিকে ছুঁড়ে মারল। যা উঁচু দেয়ালের উপর দিয়ে উড়ে গেল। কেবলমাত্র একটা পাথর ছুঁড়ে আমি তার খুলিতে আঘাত করে তাকে ধরাশয়ী করেছিলাম।
যদিও প্রথম থেকেই বৃদ্ধ লোকটির শক্তি সম্পর্কে নেফারের একটা ধারণা ছিল এবং এও জানত যে তার সহ্য ক্ষমতা লোকগাঁথা সম পর্যায়ের, তবুও তার এই লক্ষ্যভেদী নিক্ষেপে সে অবাক না হয়ে পারল না। সে পর্বতের চেয়েও বয়স্ক, আমার দাদির চাইতে বড়। কারণ সে আমাকে যেমন করে লালন-পালন করছে। দাদিকেও সেভাবেই করেছে, নেফার বিস্মিত হল। লোকে বলে সে নীল নদের দুশ বন্যা দেখেছে, পিরামিডগুলো নিজ হাতে তৈরি করেছে। নেফার উচ্চঃস্বরে জানতে চাইল, তুমি কি তার মাথাটা কেটে ঐ স্কুপের মধ্যে রেখেছিলে, টাটা? সে বীভৎস নিদর্শনটি নির্দেশ করল।