আবারো নিজের সুপিরিয়রকে খাটো করল ছেলেটা। জো সিসেরো এবারে। সর্বশেষ কারণটা খুঁজে পেলেন তাকে অপছন্দ করার। ছেলেটার তারুণ্য, স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্য। ব্যথার মতো মনে পড়ে গেল নিজের নশ্বরতার কথা। মারা যাচ্ছেন জো সিসেরো।
ছোট্ট বেলা থেকেই চেইন স্মোকার সিসেরো এই তার্কিশ সিগারেটগুলো। খেয়ে আসছেন আর অবশেষে শেষবার মস্কো ভ্রমণের সময় ফুসফুসে ক্যান্সার পেয়েছেন ডাক্তারেরা। নিরাময়ের জন্য স্বাস্থ্যসনে ভর্তি হবার কথা জানালেও জো সিসেরো কাজের মাঝে ডুবে থাকার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছেন। চেয়েছেন নিজের ডিপার্টমেন্ট যোগ্য কোনো উত্তরসূরির হাতে দিয়ে যাবেন। তখন তো জানতেন না যে এই স্প্যানিয়াডটার হাতে দিয়ে যেতে হবে; তাহলে হয়ত স্বাস্থ্য নিবাসকেই বেছে নিতেন।
এখন তো রীতিমতো ক্লান্ত আর নিরুৎসাহ লাগে সবকিছুতে। নিজের শক্তি আর উচ্চাকাক্ষার সব শেষ করে ফেলেছেন। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে চুলগুলো ছিল ঘন আর কালো। আর এখন অ্যাজমা রোগীর মতো কাশি আর হাঁপানি ছাড়া বারো কদমও চলতে পারেন না।
আজকাল তো প্রায়ই রাতে ঘুম ভেঙে গেলে, ঘামতে ঘামতে অন্ধকারে নিঃশ্বাসের কষ্টের সাথে মনে পড়ে ভয়ংকর সব চিন্তা। সারা জীবন ব্যয় করে দিয়ে কী করলেন তিনি? কী পেলেন? কতটা সফল হলেন?
কেজিবি’র চতুর্থ পরিচালকের দপ্তরে আফ্রিকান ডিপার্টমেন্টে আছেন প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেল। গত দশ বছর ধরে দক্ষিণের হেড হিসেবে কাজ করছেন। আর স্বাভাবিক যে তাঁর এবং ডিপার্টমেন্টের পুরো মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই অঞ্চলের দেশ, রিপাবলিক অব সাউথ আফ্রিকা।
টেবিলে বসে থাকা অন্য লোকটা দক্ষিণ আফ্রিকার। এতক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে থাকলেও এবারে নরম স্বরে বলে উঠল, “আমি বুঝতে পারছি না যে মেয়েটাকে নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করার দরকার কী। আমাকে বুঝিয়ে বলো।”
টেবিলে বসা শ্বেতাঙ্গ দু’জনেই তার দিকে তাকাল। রালেই তাবাকা যখন কথা বলেন অন্যরা সচরাচর শুধু শোনে। এমন এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য আছে লোকটার মাঝে যে আপনাতেই কৰ্তত্ব এসে যায়।
সারা জীবন ধরেই জো সিসেরো কালো আফ্রিকানদের সাথেই কাজ করে এসেছেন। লিবারেশন ফোর্সেসের নেতারা শুধু জীবন ভর সংগ্রাম করে গেছেন। লিবারেশন ফোর্সেসের সমস্ত ন্যাশনালিস্ট নেতাদেরকেই চেনেন। তারা হলো জোমো কেনিয়া, কেনেথ কুয়ান্তা, কৌমি নাকুমাহ এবং জুলিয়াস নাইরিরি প্রমুখ। কাউকে কাউকে তো বেশ ব্যাক্তিগতভাবে জানেন : শহীদের মৃত্যুবরণ করা মোজেস গামা আর হোয়াইট রেসিজম এর স্বীকার, কারাবাসরত নেলসন ম্যান্ডেলা।
এই কীতির্মান কোম্পানির একেবারে প্রথম স্থান রালেই তাবাকাকে দিয়েছেন সিসেরো। বস্তৃত মোজেস গামার ভাগনে এই রালেই আর দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ যে রাতে গামাকে খুন করেছিল, তখন সেও উপস্থিত ছিল। মোজেস গামা’র বিশাল ব্যক্তিত্ব আর চারিত্রিক শক্তির পুরোটাই পেয়েছে। তাবাকা। তাই গামার শূন্য স্থান পূরণে এগিয়ে এসেছে। ত্রিশ বছর বয়সে স্পিয়ার আব দ্য নেশন এর ডেপুটি ডিরেকটর, দক্ষিণ আফ্রিকা ন্যাশনাল কংগ্রেসের সামরিক শাখাসহ সিসেরো জানেন যে এ এন সি’র কাউন্সিলেও নিজেকে বহুবার প্রমাণ করেছে তাবাকা।
শ্বেতাঙ্গ স্প্যানিশ ওই ছোঁকড়াটার চেয়েও তাবাকা’কে সিসেরো বেশি পছন্দ করলেও বুঝতে পারলেন যে বংশ আর রঙের পার্থক্য ছাড়া এরা দু’জনে হল একই ছাচে গড়া মানুষ। শক্ত আর বিপদজনক, মৃত্যু আর সহিংসতা ভালোই জানে, বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো কুশলী। এদের হাতেই নিজের লাগাম দিয়ে যেতে হবে সিসেরোকে আর এই কারণেই তাদেরকে তার এত অপছন্দ। “এই মেয়েটা” ভারী কণ্ঠে জানালেন তিনি, “হতে পারে তুরুপের তাস। যদি তাকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরো সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়। কিন্তু মারকুইস পুরোটা জানাবে। এটা তার কেস আর সাবজেক্ট নিয়ে সে ভালোই স্টাডি করেছে।
সাথে সাথে রামোন মাচাদো’র হাসি মুছে গিয়ে চোখ জোড়া হয়ে উঠল তীব্র। “আমি আশা করব কমরেড ডিরেকটর এই পদবী আর ব্যবহার করবেন না। এমনকি মজা করেও না।” ঠাণ্ডা স্বরে জানালো রামোন।
জো সিসেরো বুঝতে পারলেন যে একমাত্র এই পথেই সম্ভব স্প্যানিয়ার্ডটাকে কাবু করা। “মাফ চাইছি, কমরেড।” কপট প্রার্থনার ভঙ্গিতে বললেন সিসেরো।” যাই হোক শুরু করে দাও।”
সামনে পড়ে থাকা হালকাভাবে বাঁধা কাগজের তোড়া খুলে ফেলল রামোন মাচাদো। কিন্তু একবারের জন্যও তাকালো না। ভালোভাবেই জানে কী লেখা আছে।
“মেয়েটার কেস নাম দিয়েছি “লাল গোলাপ।” আমাদের মনোবিজ্ঞানী ওর পুরো প্রোফাইল তৈরি করেছে। মূল্যায়নে জানা গেছে এই নারী যে কোন নিখুঁত কাজ পাবার জন্য অসম্ভবভাবে যোগ্য। কাজে লাগাতে পারলে মূল্যবান ফিল্ড অপারেটর হয়ে উঠতে পারবে।”
আরো মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য সাগ্রহে সামনে ঝুঁকে এলো রালেই তাবাকা। রামোন খেয়াল করে দেখল যে এ পর্যায়ে ও কোনো প্রশ্ন কিংবা মন্ত ব্য করল না লোকটা। ভালই হল। দুজনে এখন পর্যন্ত একসাথে তেমন কাজ করা হয়নি। এ নিয়ে তৃতীয়বার সাক্ষাৎ। পরস্পরকে এখনো ওজন করে দেখছে দু’জনেই। “লাল গোলাপকে অনেকভাবেই ব্যবহার করা যাবে। বাবার দিক থেকে মেয়েটা দক্ষিণ আফ্রিকার শেতাঙ্গ শাসক গোষ্ঠীর সদস্য। ব্রিটেনে দেশের অ্যাম্বাস্যাডর হয়ে মাত্রই নিজের মেয়াদ পূর্ণ করেছেন ভদ্রলোক। ফিরে গিয়ে ন্যাশনাল আর্মামেন্টস ইন্ড্রাস্ট্রির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেবার কথা চলছে। ফিন্যান্স, ল্যান্ড আর মাইনের উপরও লোকটার বিশাল প্রভাব আছে। অপেনহেইমার’স আর তাদের অ্যাংলো আমেরিকান কোম্পানির পর দক্ষিণ আফ্রিকাতে সম্ভবত এই পরিবারটিই সবচেয়ে ধনী আর প্রভাবশালী। এর পাশাপাশি আবার শাসক গোষ্ঠীর একেবারে উচ্চ পর্যায়েও বেশ ভাল জানা শোনা আছে তার। যাই হোক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো লাল গোলাপ বলতে অজ্ঞান মেয়েটার বাবা। তাই একটু চেষ্টা করলেই যে কোনো কিছু পেতে পারে এই নারী। এর মাঝে আছে সরকারের যে কোনো পর্যায়ে প্রবেশ থেকে শুরু করে অতি গোপনীয় সব তথ্য বের করে আনা, এমনকি যদি তা আর্মামেন্টস, করপোরেশনে তার নিয়োগ সম্পর্কিতও হয় না কেন।”