জান্দ্রা রোডস এর নকশা করা পোশাকটার রঙ এক অদ্ভুতি স্বর্গীয় মেঘ যেন; এর উপর সিকুইন আর মুক্তোদানার কাজ। এমনকি ন্যানিও মাথা নেড়ে হা হয়ে তাকিয়ে রইল ওর সামনে ঘুরতে থাকা ইসাবেলার দিকে।
শেফ এর সাথে শেষ মিনিটের জরুরি কথা সারতে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেক নেমেও আরেকটা কথা মনে পড়ায় হঠাৎ করে থেমে গেল বেলা।
আজকের ডিনার গেস্টদের একজন তো আবার স্প্যানিশ চার্জ-ডি অ্যাফেয়ার্স। তাই সেকেন্ডের মাঝেই টেবিল সাজানোর পরিকল্পনা নতুন করে করে ফেলল।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।” নামটা শোনার সাথে সাথেই মাথা নাড়ল স্প্যানিশ চার্জ। “পুরনো আন্দা রুসিয়ান পরিবার। আমার যতটা মনে পড়ছে গৃহযুদ্ধের পরপরই মারকুইস ডি সান্তিয়াগো ই মাচাদো স্পেন ছেড়ে কিউবা চলে গেছেন। একটা সময়ে দ্বীপের চিনি আর তামাকের উপর বেশ বড় ব্যবসা থাকলেও আমার ধারণা ক্যাস্ট্রো সব পরিবর্তন করে দিয়েছেন।”
একজন মারকুইস-মুতখানেক চুপ করে কী যেন ভাবল। স্প্যানিশ অভিজাত সম্পদ্রায় সম্পর্কে ওর জ্ঞান যৎসামান্য হলেও মনে হল মারকুইস র্যাঙ্ক ডিউকের ঠিক নিচেই হবে।
“দ্য মারকুইসা ইসাবেলা ডি-সান্তিয়াগো-ই-মাচাদো” ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাটা মাথায় আসতেই মনে পড়ে গেল ওই ভয়ংকর সবুজ চোখ জোড়া আর একটুক্ষণের জন্য মনে হলো দমবন্ধ হয়ে যাবে। কণ্ঠের উত্তেজনা চাপাতে না পেরেই জানতে চাইল, “মারকুইস এর বয়স কত?”
“ওহ, এতদিনে কিছুটা তো হয়েছেই। মানে যদি এখনো বেঁচে থাকেন। ষাটের শেষ কিংবা সত্তরে।”
“কোনো পুত্র সন্তান আছে নিশ্চয়ই?”
“আমি আসলে জানি না।” মাথা নাড়লেন চার্জ। “কিন্তু খুঁজে বের করা শক্ত কিছু না। আপনি চাইলে আমি অনুসন্ধান করে দেখব।”
“ওহ্, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।” লোকটার বাহুতে হাত রেখে নিজের সবচেয়ে সুন্দর হাসি হাসল বেলা।
মারকুইস হও কিংবা না হও, এত সহজে ইসাবেলা কোর্টনির কাছ থেকে নিস্তার নেই তোমার। ধূর্তের মতো ভাবল মেয়েটা।
***
“প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে গেল তার কাছে যেতে আর যখন অবশেষে পারলে সাথে সাথে আবার চলে যেতে দিলে।” টেবিলের মাথায় বসে থাকা লোকটা হাতের সিগারেট ঘসে নিভিয়ে ফেলল সামনে রাখা উপচে পড়া অ্যাশট্রেতে। সাথে সাথে আকেরটা জ্বালালো। লোকটার ডান হাতের প্রথম দুটো আঙুলের ডগায় গাঢ় হলুদ দাগ। আর তার্কিশ সিগারেটের ধোয়ায় এরই মাঝে ছোট্ট রুমটাতে নীল রঙা মেঘ জমে গেছে।
“তোমাকে কী এই অর্ডার দেয়া হয়েছিল?” জানতে চাইল লোকটা।
হালকাভাবে কাঁধ ঝাঁকাল রামোন মাচাদো। মেয়েটার মনোযোগ পাবার জন্য এই একটাই উপায় ছিল। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে ছেলেদের সঙ্গ পাওয়া এই মেয়ের কাছে পানি-ভাত। আঙুল তুললেই পুরুষেরা এসে হামলে পড়বে। মনে হয় এবার আমার ব্যাখ্যাটা বিশ্বাস করবেন।”
“তুমি তাকে চলে যেতে দিয়েছ।” বৃদ্ধ জানে তিনি বারবার একই কথা বলছেন তারপরেও এই ছেলেটা পাত্তা দিচ্ছে না।
এই তরুণকে সে পছন্দ করে না আর এতটা জানেও না যে বিশ্বাস করবে। এমন নয় যে কখনো তার অধীনস্থদের কাউকে বিশ্বাস করেনি। যাই হোক এই ছেলেটা একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী। অফিসারের চেয়ে নিজের মতই তার কাছে শ্রেয়।
চোখ বন্ধ করে ফেললেন জো সিসেরো। পুরনো ইঞ্জিনে অয়েলের মতই অস্বাচ্ছ আর কালো জোড়া চোখ, কান আর কপালের উপর পড়ে আছে রূপালি সাদা চুল।
“তোমার উপর আদেশ ছিল কনট্যাকট তৈরি করা।”
“উইদ রেসপেক্ট, কমরেড ডিরেকটু, আমার উপর, আদেশ ছিল মেয়েটার বিশ্বাস অর্জন করা, পাগলা কুত্তার মতো ওর দিকে ছুটে যাওয়া নয়।
না, জো সিসেরো কিছুতেই তাকে পছন্দ করতে পারছে না। আচরণে ঔদ্ধত আছে; কিন্তু শুধু সেটাই কারণ না। ছেলেটা একটা বিদেশি। রাশান নয় এমন সবাইকেই বিদেশি ভাবেন সিসেরো। আন্তজার্তিক সমাজতন্ত্র যাই বলুক কেন পূর্ব জার্মান, যুগোশ্লাভ, হাঙ্গেরীয়রা, কিউবা আর পোলিশ সকলেই তাঁর কাছে বিদেশি।
মাচাদো শুধু যে বিদেশি তা নয়, ওর পুরো শেকড়ই হচ্ছে দুর্নীগ্রিস্ত। ছেলেটা না কোনো প্রোলাতারিয়েট বংশ থেকে এসেছে, না কোন হতাশাগ্রস্ত বুর্জোয়া পরিবার থেকে। বরঞ্চ ঘৃণ্য সেই সুবিধাভোগী অভিজাত পরিবারেরই সন্তান।
যদিও মাচাদো তার পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে কিছু পেতে চায় না, তারপরেও সিসেরো তাকে বিশ্বাস করে না।
মোটের উপর আবার ছেলেটা স্পেনে জন্মগ্রহণ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে এই ফ্যাসিস্ট দেশটা শাসন করেছিল ক্যাথলিক রাজাগণ, যারা ছিল জনগণের শত্রু। এখন তো আরো বেশি। একনায়ক ফ্রাঙ্কো গলা টিপে হত্যা করেছে কম্যুনিস্ট বিপ্লব। নিজেকে তাই ছেলেটা কিউবার সোশালিস্ট হিসেবে দাবি করলেও জো সিসেয়োর কাছে অভিজাততন্ত্রের দুর্গন্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়।
“তুমি তাকে যেতে দিয়েছ।” আবারো জোর দিয়ে একই কথা বললেন। “এই সময় আর অর্থ সবই নষ্ট হয়েছে।” সিসেরো উপলব্ধি করলেন যে, কী পরিমাণ গুরুভার চেপে বসেছে তার উপর। শক্তিও কমে আসছে। অসুস্থতা এরই মাঝে চিন্তা ভাবনাকে ধীর করে দিচ্ছে।
রামোন হেসে ফেলল। আর এই গা জ্বালানো হাসিটা সবচেয়ে অপছন্দ করেন সিসেরো। “মাছের মতই, বরশিতে গেঁথে গেছে মেয়েটা। যতক্ষণ না আমি তীরে তুলে আনছি শুধু সাঁতারই কাটতে থাকবে।”