‘রামোন ডি সান্তিয়াগো ই-মাচাদো।” নিজের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে রইল বেলা। সোজা হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। চেষ্টা করল তাড়াহুড়া না করতে। ধীরে ধীরে, লম্বা স্টিলেটো হিল পরা পায়ে কোমর দুলছে চলার ছন্দে।
ঘন পাপড়ি দিয়ে চোখ ঢেকে আস্তে করে বাইরে বের হয়েই জমে গেল
চলে গেছে রামোন। মনে হল নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। পাকস্থলীতে যেন পাথর গিলে ফেলেছে ভুল করে। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাল। দৌড় দিয়ে সামনে গিয়ে নাম ধরে ডাকল, “রামোন।” ওর দিকে আরো শত শত দেহ এগিয়ে আসছে গানের আসর ছেড়ে; কিন্তু কাক্ষিত সেই অবয়ব কোথায়ও নেই।
“রামোন” ডাকতে ডাকতে এস্তপায়ে গেইটের দিকে এগোল বেলা। বেইজওয়াটার রোড লোকে লোকারণ্য। হন্যে হয়ে ডানে বামে তাকাল। কিছুতেই বিশ্বাস করতে মন চাইছে না, চলে গেছে। এমনটা আর কখনো হয়নি। রামোনের প্রতি নিজের আগ্রহ দেখিয়েছে বেলা তারপরেও সে চলে গেছে।
ক্ষোভে ফেটে পড়ল মেয়েটা। ইসাবেলা কোর্টনির সাথে এমনটা আর কেউ কখনো করেনি। নিজেকে মনে হল অসম্ভব তুচ্ছ, অপমানে রাগ উঠে গেল।
“ধুত্তোরি, চুলোয় যাক রামোন।”
কিন্তু সেকেন্ড খানেকের মাঝেই রাগ পানি হয়ে গেল। মনে হলো চারপাশ খালি হয়ে গেছে। কেমন এক অদ্ভুত শূন্যতা গ্রাস করে নিল সবকিছু।
চিৎকার করে বলে উঠল, “ও এমন করতে পারে না। তারপর আবারো। কিন্তু লাভ হল না।
পেছনে হৈ-হল্পা শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল তাড়াতাড়ি। একদল হেলস্ এনজেলস এর সৈন্য এগিয়ে আসছে। শ’খানেক গজ দূর থাকলেও সোজা এদিকেই আসছে। এখানে আর থাকা উচিত হবে না।
কনসার্ট শেষ, সবাই যে যার পথে চলে যাচ্ছে। যে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনেছিল সেটা নিশ্চয়ই জাগার আর তার রোলিং স্টোন’কে নিতে এসেছে। বন্ধুদের সাথে দেখা করার এখন আর সুযোগ নেই; এত মানুষের ভিড়ে সবাই হারিয়ে গেছে। নিজের চারপাশে দ্রুত আরেকবার চোখ বুলিয়ে খুঁজে দেখল ঘন ঢেউ খেলানো চুলের রাশি। মাথা ঝাঁকিয়ে চিবুক তুলে আপন মনে বলে উঠল, “কেইবা ওর পথ চেয়ে আছে?” নেমে গেল রাস্তায়।
পেছনে শোনা গেল হুইসেলের শব্দ। এনজেলস্ এর কেউ ওকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, লেফট, রাইট, লেফট-”
বেলা জানে যে হাইহিলের জন্য কোমর অসম্ভব জোরে দুলছে। জুতা খুলে তাই খালি পায়ে হাঁটতে শুরু করে দিল। স্ট্যান্ডে অ্যামব্যাসি কার পার্কের কাছে গাড়ি রেখে এসেছে। তাই ল্যাঙ্কাস্টার গেইট স্টেশন থেকে টিউব ধরতে হবে।
ব্রান্ড নিউ মিনি কুপার চালায় বেলা, একেবারে লেটেস্ট ১৯৬৯ মডেল। জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছে। অ্যান্থনী আর্মস্ট্রং এর মিনি যেখানে থেকে সাজগোজ করে আনা হয়েছে সেই একই জায়গা থেকে তারটাও আনা হয়েছে।
ছোট্ট ব্যাকসিটে জুতা ছুঁড়ে ফেলে ইঞ্জিন চালু করল বেলা। টায়ারের ঘর্ষণ শোনা গেল-কারপার্কে। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলির দিকে তাকিয়ে রিয়ার ভিউ মিররে পৈশাচিক উল্লাস ফুটে উঠল ওর চোখ মুখে। ইচ্ছে মতো গাড়ি চালাতে লাগল মেয়েটা। মেট্রোপলিটান পুলিশের হাত থেকে বেঁচে গেল-ডিপ্লোমেটিক প্লেট নাম্বার থাকায়। ড্যাডিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
হাইভেল্ড পর্যন্ত আসতে নিজের পুরনো রেকর্ড ভেঙে ফেলল বেলা। পৌঁছালো চেলসি’তে অ্যাম্বাস্যাডরস রেসিডেন্সে প্রবেশ পথে পার্ক করে রাখা আছে ড্যাডির অফিসিয়াল বেন্টলি। শফার ক্লোনকি ওকে দেখে হেসে স্যালুট করল। কেপ টাউন থেকে নিজের বেশির ভাগ স্টাফ নিয়ে এসেছে ড্যাডি।
নিজেরে মুড সামলে নিয়ে ক্লোনকির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে চাবি ছুঁড়ে মারল বেলা। “আমার গাড়িকে সরিয়ে নিয়ে যাও ডিয়ার ক্লোনকি।” পরিচারকদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে সে ব্যাপারে ড্যাডি বেশ কড়া। অন্য যে কারো উপর মুড দেখাতে পারলেও ওদের উপর নয়। ড্যাডির মতে, “ওরা পরিবারেরই অংশ বেলা।” আর তাদের বেশির ভাগই আসলে উত্তমাশা অন্তরীপে পারিবারিক আবাস ওয়েন্টেড্রেডেনে ওর জন্মের আগে থেকেই আছে।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে বাগানের দিকে বানানো স্টাডির ডেস্কে বসে আছে ড্যাডি। কোট-টাই খুলে রেখেছে আর ডেস্কের উপর ছড়িয়ে আছে অফিসিয়াল ডকুমেন্টস্। তারপরেও মেয়েকে ঢুকতে দেখে কলম নামিয়ে চেয়ার ঘুরিয়ে তাকাল বেলার দিকে। খুশি হয়ে উঠলেন সন্তানের আগমনে।
বাবার কোলে ধপ করে বসে পড়ে কি করল বেলা। “ঈশ্বর, এ পৃথিবীতে তোমার মতো সুন্দর আর কেউ নেই।” হেসে ফেললেন শাসা কোর্টনি। “কেন বল তো?”
“পুরুষেরা হয় বিরক্তিকর নয়তো শুয়োের। তবে তুমি ছাড়া। “আহ্! আর রজারই বা কী করল যে ক্ষেপে গেছ? আমার তো তাকে একেবারে খারাপ লাগে না।”
কনর্সাটে যাবার সময় ওকে পাহারা দিয়েছিল ব্লজার। তবে মঞ্চের সামনের ভিড়ের মাঝেই তাকে রেখে এসেছে বেলা। এতক্ষণে মাত্র মনে পড়ল ওর কথা। “জীবনেও আমি আর কোনো ব্যাটা ছেলের পাশে যাচ্ছি না।” ঘোষণা করল ইসাবেলা। “হয়ত কোনো সন্ন্যাসিনীদের আশ্রয়ে চলে যাব।”
“স্বর্গীয় এই আদেশ কি কাল পর্যন্ত বলবৎ করা যায়? আজ সন্ধ্যায় ডিনারে আমার এক অতিথি আসছেন অথচ এখন পর্যন্ত কিছুই ঠিক হয়নি।”
“হয়ে গেছে, বহু আগেই। আমি কনর্সাটে যাবার আগেই সব ঠিক করে গেছি।”
“মেনু?”
“আমি আর শেফ মিলে গত শুক্রবারেই তা ঠিক করে রেখেছি। ভয় পেও না পাপা। সব তোমার পছন্দের খাবার : কোকুইলিস সেইন্ট জ্যাকস আর ক্যামডি থেকে ল্যাম্ব।” কারু’তে নিজের ফামের ল্যাম্বই কেবল পরিবেশন করেন শাসা। মরুভূমির ঝোঁপ ঝাড়ে পালিত হওয়ায় অন্যরকম এক স্বাদ আসে ভেড়ার মাংসে। অ্যামব্যাসিতে গরুর মাংস আসে রোডেশিয়াতে তার র্যাঞ্চ থেকে। আর ওয়াইন আসে ওয়েন্টেড্রেডেনের আঙ্গুর ক্ষেত থেকে। সেখানে গত বিশ বছর ধরে তার জার্মান ওয়াইনমেকার অসম্ভব অধ্যবসায় আর নিখুঁত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বাড়িয়ে চলেছে এর গুণ। তার উচ্চাকাঙ্খা হলো এমন এক ওয়াইন তৈরি যা কোতে ডি.আর.এর সাথে টেক্কা দিতে পারবে।