নৌকাতে উঠেও নিকি’র ঘাড় ছাড়ল না শন। জ্বলন্ত কুড়ে ঘরগুলোর শিখা’র ছায়া পৌঁছে গেছে মেঘের পেট অব্দি। আউটবোর্ড মোটরের শব্দ ছাপিয়েও শোনা যাচ্ছে চিৎকার আর অটোমেটিক গান ফায়ারের আওয়াজ।
“ওরা কা”কে গুলি করছে?” ভাইয়ের উষ্ণ বুকে আশ্রয় নিয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইল বেলা।
“হয়তো ছায়ার দিকে-কিংবা একে অন্যের গায়ে নরম স্বরে হাসল শন।
অনুকূল স্রোত পাওয়াতে দ্রুত হৃদের মুখে পৌঁছে গেল নৌকা বহর। নিজের নাইটস্কোপ লাগিয়ে তীর থেকে ছুটে আসা অপর বহর টাকে দেখতে পেল ইসাউ গনডেল। শৈলশিরার কাছে এসে পাশাপাশি হয়ে গেল দুই দল। তারপর সারি বেঁধে চলল খোলা সমুদ্রে।
মাত্র আধা মাইল দূরেই চকচক করে জ্বলছে হলুদ রঙা ল্যান্সার।
সর্বশেষে বোটের আরোহীরা উপরে উঠে আসার সাথে সাথেই গর্জে উঠল ইঞ্জিন। খোলা আটলান্টিকের দিকে ছুটল ল্যান্সার।
ইসাউ গনডেলের দিকে তাকাল শন, “এবারে লাভ-লোকসানের হিসাব দাও সার্জেন্টমেজর গনডেল।
“আমরা একজনকে হারিয়েছি মেজর কোর্টনি” স্বাভাবিকভাবেই রিপোর্ট দিল গনডেল, “জেরেমিয় মাসোগা। আমাদের সাথে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি।” স্কাউটেরা কখনো মত সঙ্গীকে ফেলে আসে না।
সেই চির পরিচিত শূন্য হয়ে যাবার, অনুভূতিটা বোধ করল শন; আরেকটা ভালো মানুষ চলে গেল। জেরেমিয়ের বয়স ছিল মাত্র উনিশ। ওকে সেকেন্ড স্ট্রাইপ দেয়ার ব্যাপারে এরই মাঝে মনস্থির করে ফেলেছিল শন। কিন্তু সে সুযোগ আর পাওয়া গেল না। কেন যে কদিন আগেই করল না কাজটা। মৃতদের কাছে তো ক্ষমা চাইবারও কোনো সুযোগ নেই। “তিনজন আহত; তবে এতটা ব্যথা পায়নি যে আজ রাতের পার্টি মিস করবে।”
“রেফ্রিজারেটেড হোন্ডে জেরেমিয়’কে রেখে দাও।” আদেশ দিল শন। “কেপ টাউনে পৌঁছাবার সাথে সাথেই ওকে ঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। পরিপূর্ণ সামরিক মর্যাদায় জেরেমিয়কে সমাহিত করা হবে।”
টেবিল বে থেকে দুইশ নটিক্যাল মাইল দূরে থাকতেই শন, ইসাবেলা আর নিকি’কে তুলে নেবার জন্য কোর্টনি হেলিকপ্টার পাঠালেন সেনটেইন কোর্টনি। গ্রেট-গ্র্যান্ডসনকে দেখার জন্য বুড়ি’র কিছুতেই তর সইছে না।
***
৯. স্রোতের টান
স্রোতের টান থেকে বাঁচার জন্য একটা ম্যানগ্রোভ গাছের শিকড় আঁকড়ে ধরল রামোন। ধারালো শামুকের খোসায় কেটে গেল হাত। কিন্তু একটুও ব্যথা টের পেল না রামোন মাচাদো। এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে নদীর দিকে।
জ্বলন্ত কম্পাউন্ডের ছায়া পড়েছে পানিতে; সোনার মত চকচক করছে নিকষ কালো নদী।
মাত্র পঞ্চাশ ফুট দূর দিয়ে চলে গেল শনে’র নৌকা বহর। চিবুক পর্যন্ত কাঁদায় ডুবিয়ে গাছ আঁকড়ে বসে রইল রামোন। রাতের বীরবতার মাঝে নরম গুণগুণ এক ধরনের আওয়াজ করছে মোটর। অন্ধকারে কারো চেহারাই আলাদাভাবে বোঝা না গেলেও কল্পনার চোখে ধূসর রঙা টি-শার্ট পরা ছোট্ট একটা দেহ দেখতে পেল সামনের নৌকায়।
আর তখনই অনুভব করল যে ও নিজেও আসলে একজন বাবা। জীবনে প্রথমবারের মতো স্বীকার করতে বাধ্য হলো এই ভালোবাসার অস্তিত্ব। নিজের ছেলেকে হারিয়ে গুঙ্গিয়ে উঠল রামোন।
ভেতরে দানা বেঁধে উঠা ক্রোধের কাছে হেরে গেল বাকি সব অনুভূতি। এর জন্য দায়ী সকলের উপর প্রচণ্ড রাগ হতে লাগল। সামনের শূন্য আঁধারের দিকে তাকিয়ে সর্বাঙ্গে যেন আগুন ধরে উঠল। ইচ্ছে করে চিৎকার করে অভিশাপ দেয়, মেয়েটাকে চুলের মুঠি ধরে নামিয়ে আনে, কিন্তু কিছুই করল না। এভাবে কখনো করে’ও না। এখন তাকে হতে হবে লোহার মতই শীতল আর তীক্ষ্ণ। প্রতিশোধ নেবার জন্য পরিষ্কারভাবে ভাবতে হবে সবকিছু।
প্রথমেই মনে হলো যে লাল গোলাপের উপর আধিপত্য হারিয়ে গেল। তার মানে রামোনের কাছে মেয়েটার এখন আর কোনো মূল্য নেই। এখন ও’কে তাই উৎসর্গ করার সময় এসেছে। রামোন ভালো করেই জানে কিভাবে তাকে আর তার চারপাশকে ধ্বংস করতে হবে।
ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ ছেড়ে দিয়ে পানিতে ভেসে পড়ল রামোন। নদীর মোড়ে এসে ব্রেস্ট-স্ট্রোক দিয়ে ফিরে এলো তীরে।
পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া কমুনিকেশনস সেন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে রামোনের জন্য অপেক্ষা করছে রালেই তাবাকা। দ্রুত হাতে ট্রাউজার আর জ্যাকেট শরীরে জড়িয়ে নিল রামোন। ভেজা চুলে এখনো লেগে আছে নদীর কাদা।
অঙ্গার হয়ে যাওয়া দালানের ধোঁয়ার মাঝেই দেখা গেল প্রভাতের প্রথম সূর্য রশ্মি। রালেই তাবাকা’র লোকেরা মৃতদেহগুলো জড়ো করে তাল গাছের নিচে এক সারিতে রেখে দিয়েছে। যেভাবে মৃত্যু হয়েছে সে ভঙ্গিতেই পড়ে আছে মৃতেরা। প্যারাট্রুপার জোসে, মুখের উপর এক হাত এমনভাবে ফেলে, রেখেছে যেন চোখ দুটোকে বাঁচাতে চাইছে। গ্রেনেডের শার্পনেল টুকে মোরব্বা হয়ে গেছে ওর বুক। আদ্রা হাত দুটোকে এমনভাবে ছড়িয়ে রেখেছে। যেন ওকে ক্রুশে দেয়া হয়েছে। মেয়েটার মাথার এক পাশ নেই হয়ে গেছে। আবেগহীন চোখে তাকিয়ে দেখল রামোন; যেন পুরোন কোনো কাপড়ের ছেঁড়া অংশ যার এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই।
“কতজন?” রালেই তাবাকা’কে প্রশ্ন করল রামোন।
“ছাব্বিশ জন। উত্তরে জানালেন রালেই। “সবাই মারা গেছে। কেউ বেঁচে নেই। যেই এসে থাকুক না কেন, পরিষ্কার একটা কাজ করে গেছে। জানেন ওরা কারা?”
“হ্যা” মাথা নাড়ল রামোন। “ভালো করেই জানি।” রালেই তাবাকা আর কিছু বলার আগেই জানাল : “এখন থেকে সিনডেক্স প্রজেক্টের সব দায়িত্ব আমার।”