গোল্ডেন বাউ দেখতে রেসের ঘোড়ার মতই সুন্দর এবং মনোমুগ্ধকর। সে, যে কোনো গতিতে পানি কেটে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। বাতাসের সাহায্য পেলে পাল ভোলা অবস্থায় ওটা যেকোনো যুদ্ধ জাহাজকে ধোকা দিয়ে পালিয়ে আসতে পারে, সেই সাথে তার চেয়ে বেশ কিছুদূর সামনে এগিয়ে থাকা জাহাজকে তাড়া করে ধরে ফেলত পারে খুব সহজেই। রেসের ঘোড়ার দক্ষ জকির মতো গোল্ডেন বাউও এমন একজন যোগ্য ক্যাপ্টেন পেয়েছে যে কি-না ভয়ংকর দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেও গোল্ডেন বাউকে দৃঢ়তার সাথে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে যেখানে অন্য যুদ্ধ জাহাজগুলো তাদের ভারসাম্য ধরে রাখতেই রীতিমত হিমশিম খায়।
গোল্ডেন বাউ-এর ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে হাল কার্টনিকে অনেক যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছে; কখনো বা বায়ুহীন পথে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াতে হয়েছে বিশাল জলরাশির বুকে, কিংবা কখনো ভয়াবহ মেইলস্টর্ম-এর রাতে একাকী হাতে জাহাজটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে সম্পূর্ণ সাহস আর দৃঢ়তার ওপর ভর করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, জাহাজের পাটাতন থেকে শুরু করে রাডার পর্যন্ত সবকিছুই তার ভালভাবে চেনা আছে। হাল খুব পরিষ্কারভাবেই জানত যে কঠিন বিপদের সময় জাহাজটাকে কিভাবে চালিয়ে নিতে হয়। হাল জানত যে জাহাজ ভাসানোর সময় কিভাবে এর কামানের গান-পাউডারগুলোকে ব্যালেন্স করতে হয়। কেউ কেউ হয়ত দ্রুত চালানোর জন্য অল্প কিছু বন্দুকের ওপর নির্ভর করে আবার কেউ কেউ ফায়ার পাউডার এর ওপর নির্ভর করে। গোল্ডেন বাউ-এর গতি বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট কামান এবং গান পাউডার মজুদ রেখেছে হাল কার্টনি। তার জাহাজে যে মাপের কামান থাকা দরকার ঠিক সেই মাপের কামানই সে বেছে নিয়েছে। এক বাক্যে, মারাত্মক সব অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং কামানের সংগ্রহশালা বলা যায় তার জাহাজটাকে। যে-কোনো শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য তার জাহাজ সদা সর্বদা প্রস্তুত। বাউ-এর বাহুগুলো যেমন দ্রুতগামী দাঁতগুলোও তেমনি শক্ত। আর এ কারণেই জাহাজটার ক্যাপ্টেন ওটাকে এতটা সম্মান ও প্রশংসার চোখে দেখে।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই, ক্যাপ্টেন যখন তার এতদিনের ভালবাসার জাহাজটাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল তখন সে চাইছিল ওটা যেন তার সেরা রূপেই থাকে। চারমাস আগে হাল যখন আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে সমুদ্রভ্রমণে বের হয় তখন জুডিথ নাজেত তার সাথে গোল্ডেন বাউতেই ছিল। কিন্তু তখন অপ্রত্যাশিতভাবে জুডিথের ডাক আসে রাজার কাছ থেকে-তাকে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। জুডিথ যদিও খুব অল্প সময় জাহাজে ছিল, কিন্তু ওইটুকু সময়েই জাহাজের সমস্ত নাবিকের প্রশংসায় ভেসে গিয়েছিল সে। যুদ্ধক্ষেত্রে তার অবদান যেমন নাবিকদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিল ঠিক তেমনি আকর্ষণ করেছিল তার অপার সৌন্দর্য। সে যখন তার তলোয়ার এবং বর্ম নামিয়ে রাখতে, কেবল তখনই তাকে পরিপূর্ণ এক মানবী বলে মনে হতো।
জুডিথ চলে যাওয়ার পর হাল তার লোকদেরকে জাহাজ মেরামত করার আদেশ দিয়েছিল। ক্যাপ্টেনের আদেশ পেয়ে তার লোকেরা জাহাজ মেরামতের কাজ শুরু করে দেয়।
পুরো এক সপ্তাহ জুড়ে কর্মচারীরা জাহাজের পাশে দড়িতে ঝুলে ঝুলে কাজ করেছে। ঘষে ঘষে প্রতিটা কাঠ পরিষ্কার করেছে, রং করেছে, পেরেক ইকেছে। এতদিনের পুড়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া অংশ, রঙের দাগ, ছিঁড়ে যাওয়া পাল, প্রতিটা চিহ্ন বাউ-এর নাবিকেরা নিশ্চিহ্ন করেছে নতুনভাবে মেরামতের মাধ্যমে। জাহাজটার প্রতিটা কাঠের প্রতি নজর দেয়া হয়েছে। যেটা বদলানোর প্রয়োজন সেটা বদলানো হয়েছে। ঘষে ঘষে সবকিছু পরিষ্কার করা হয়েছে। গ্রিজিং করা হয়েছে, আলকাতরা লাগানো হয়েছে, রঙ করা হয়েছে, যেখান দিয়ে পানি ঢুকার মতো সম্ভাব্য ছিদ্র দেখা গিয়েছে সেটা বন্ধ করা হয়েছে খুব ভালভাবে। তারা তাদের সম্মানিত অতিথিদের জন্য যতটুকু করা দরকার তার একটুও বাদ রাখেনি। তারা জাহাজের প্রতিটা বন্দুক, প্রতিটা কুঠার, প্রতিটা বর্শা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করেছে চকচক করার আগ পর্যন্ত।
সব পরিষ্কার করা সম্ভব হলেও এক জায়গায় বিশেষ রক্তের দাগ পরিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত সেই রক্তের দাগ ছিল এক আরব সৈন্যের যার উরুতে গুলি লেগে রক্তনালী ছিঁড়ে যায়, এরপর ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে মাস্তুলের কাঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ে। কাঠ সেই রক্ত এমনভাবে শুষে নেয় যে কাঠের রংটাই বদলে যায়। হাল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার লোকদের সেই রক্ত মুছতে বলে। কিন্তু রক্ত এমনভাবে কাঠে লেগেছিল যে ঘষতে ঘষতে যখন কাঠের একটা পরদ উঠিয়ে ফেলা হলো তখনও রক্তের দাগ থেকে গিয়েছিল।
মিতসিবা হারবার পোতাশ্রয়-এর চারপাশটা বালির চর দিয়ে ঘেরাও করা। হাল তার লোকদের নির্দেশ দেয় সেই বালি উঠিয়ে এনে রক্তের দাগের ওপর ফেলতে, তারপর বালি দিয়ে ঘষে সেই রক্ত পরিষ্কার করতে।
হাল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার লোকদের কাজ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে সে নিজেও হাটুগেড়ে বসে রক্ত পরিষ্কার করার কাজে লেগে যায়। কারণ সে বিশ্বাস করে, যে কাজ কেউ নিজে করতে পারবে না, সে কাজ তার অধীনস্ত লোকদের করতে আদেশ দেয়া উচিত নয়। অবশেষে পরিষ্কার করতে করতে জাহাজের ডেকটা চাঁদের আলোতে চকচক করতে থাকে। জাহাজের ডেক থেকে যখন চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়, তখন মনে হয়, যেন একটা রঙিন আভা জাহাজটাকে ঘিরে রেখেছে।