দুজন লোক তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে কথা বলছিল, সেই সাথে অনবরত মদ্যপান করছিল। যদিও পেট অপেক্ষা করছিল আঘাত হানার সুযোগের জন্য। অপেক্ষা করতে করতে একসময় সেই মোক্ষম সময় চলে এল। এরইমধ্যে গোডিংস মদ্য পান করতে করতে মাতালের একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। পেট সচেতনভাবেই গোডিংস-এর মতো এতটা মদ্যপান করেনি। সে তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটা কাঠের বক্স থেকে ব্র্যান্ডি বের করতে গেল। ঐ কাঠের বাক্সে ছয়টা আলাদা কম্পার্টমেন্টে বিভিন্ন স্বাদের ও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ব্র্যান্ডি রাখা আছে।
গোডিংসও উঠে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে ফিরে পেটকে খেয়াল না করে মদ ঢলবার পাত্র খুঁজতে লাগল। ছুরিটা বের করে আস্তে আস্তে তার দিকে এগুতে লাগল পেট। যখনই গোডিংস-এর ডান পাশের কিডনিতে আঘাত করতে যাবে সে, তখনই গোডিংস ফিরে তাকালো।
কিন্তু এতেও পেট-এর কাজে কোনো বাধা পড়ল না। সে তার ভিক্টিম-এর প্রতিটা পদক্ষেপ, প্রতিটা অভিব্যক্তি এবং প্রতিটা নিঃশ্বাস সম্পর্কে সচেতন। গাডিংস চোখ বড় বড় করে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল। সে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি যে তার কপালে আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে। পেট এরই মধ্যে গোডিংস-এর পেটে পরপর তিনবার ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। এরকম আকস্মিক ঘটনায় ক্যাপ্টেন এতই বেশি আশ্চর্যান্বিত হয়েছে যে সে অ্যালার্ম বাজাতে বা ব্যথায় চিৎকার করতেও ভুলে গিয়েছে। তার বদলে সে পেটে হাত দিয়ে বাচ্চাদের মতো নিচে বসে পড়ে হামাগুড়ি দিতে লাগল। তার সাদা ওয়েস্ট কোট রক্তে ভিজে গিয়েছে। তার মূত্রথলি খালি হয়ে গিয়েছে ভয়ে।
গোডিংস তার সর্বশেষ শক্তিবিন্দু দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করল। মদের পাত্রটা শক্ত করে ধরে পেট-এর দিকে নিক্ষেপ করল সে। কিন্তু সচেতন পেট নিজেক সরিয়ে নিল আগেই। গোডিংস-এর নিক্ষেপ করা পাত্র ডেস্ক-এর উপরে ঝুলানো লণ্ঠনে গিয়ে আঘাত করল। সাথে-সাথে লণ্ঠনটা ভেঙে এর সমস্ত তেল পড়ে গিয়ে দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। ডেস্ক-এর ওপর কাগজ-পত্র ছড়িয়ে থাকাতে সেগুলোতে আগুন লেগে বার্নিশ করা কাঠে এবং মেঝেতে আগুন ছড়াতে খুব একটা সময় লাগল না।
পেট একটুও নড়ছে না। সে এখনো অবাক হয়ে ভাবছে যে সে কী করেছে। স্থবির হয়ে কেবিন-এর ভেতরেই দাঁড়িয়ে রইল সে। যদিও আগুন তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, সেই সাথে নিঃশ্বাস ঘন হচ্ছে তার। পালস দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে, ঠিক যেভাবে গোডিংস তার জীবনের শেষ সময় পার করছে এখন। অবশেষে, গোডিংস যখন তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল তখন যেন পেট-এর হুশ হলো। তার কাছে মনে হলো যেন সে অনেক গভীর একটা ঘুম থেকে উঠেছে। নড়াচড়ার জন্য প্রস্তুত হল সে।
পেট খুব ভাল করেই জানে সমুদ্রের ওপর আগুন কতটা ভয়াবহ হতে পারে। আর…কোনো জাহাজে যদি খনিজপদার্থ বোঝাই করা থাকে, সেই সাথে কামানের গোলাতে গান-পাউডার ভরা থাকে, তবে সেটাকে বিশাল আকৃতির একটা বোমা হিসেবে ধরে নেয়া যায়। এতক্ষণে ফিউজ-এর মধ্যে আগুন জ্বলে উঠেছে। এখন যে করেই হোক পেটকে আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড ত্যাগ করতে হবে-যত দ্রুত সম্ভব। তার মতো গোডিংস কাঠের ঝুলানো বিছানায় ঘুমাত। সে যত দ্রুত সম্ভব হুক থেকে কাঠের বিছানাটা খুলে ফেলল। এরপর সেটা জানালা দিয়ে বহু কষ্টে সমুদ্রে নিক্ষেপ করল যাতে সে ওটার ওপর ভেসে থাকতে পারে। এরপর সে নিজে জানালায় উঠে লাফ দিল।
গরম বাতাসের মধ্য দিয়ে সমুদ্রে পড়ার পর তার বিন্দুমাত্রও ধারণা ছিল না যে সে এখন কোথায় আছে। তার মনে হল সে ইন্ডিয়া এবং কেপ অফ গুড হোপ-এর বাইরে অন্য কোথাও আছে। সে এখনও বুঝতে পারছে না যে সে ভেসে থাকার জন্য আদৌও কাঠের বিছানাটা খুঁজে পাবে। এমনও হতে পারে যে এটা ঢেউয়ের সাথে অন্য কোথাও ভেসে গিয়েছে। সমুদ্র তার ভাগ্যে কী পরিণতি রেখেছে এটাও সে জানে না। তাকে হত্যা করার জন্য কেউ ওত পেতে আছে, নাকি তাকে খাওয়ার জন্য কোনো কিছু ওত পেতে আছে, সে জানে না। সবচেয়ে বড় কথা, সে নিজে সাঁতার কাটতে জানে না।
যাই ঘটুক না কেন, সেটা নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়। উইলিয়াম পেট সেই অলৌকিক বাণীর জবাব দিয়েছে। সে যা করছে, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই করছে। সে কারণে কোনো কিছুই তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এ ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত।
*
দিনের প্রথম আলোকরশ্মি যখন মিতসিওয়ার হারবার পোতাশ্রয় অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে তখন ব্রিটিশ দ্বীপের ইউনিয়ন ফ্ল্যাগ সময় উড়িয়ে খুব গৌরবান্বিত হয়ে ইথিওপিয়ান যুদ্ধ জাহাজটা নোঙর করল। গোল্ডেন বাউ জাহাজটি তৈরি করা হয়েছে জর্জ ভিসকাউন্ট উইন্টারটন এর আদেশে-দুই হাজার পাউন্ড দামের অবিশ্বাস্য খরচে। উইন্টারটন এরই মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক জাহাজ এবং যুদ্ধ-জাহাজ-এর মালিক হয়েছেন। বাউ তৈরির ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল তার প্রাণপ্রিয় পুত্র ভিনসেন্টকে একটা গ্রহণযোগ্য জাহাজ উপহার দেয়া। সমুদ্র ভ্রমণে তাদের যে পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে সেটা বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই এটা তৈরি করা হয়েছে। আর এটা তৈরির মাধ্যমে ইংল্যান্ড-এর ভাগ্যে এক নতুন মাত্রাও যোগ হয়েছে।
সেই মাননীয় ‘ভিনী” উইন্টারটন এখন কেপ অব গুড হোপ-এর উত্তরে ইন্ডিয়ান সাগরের পাশে এলিফ্যান্ট লেগুন-এর উপকূলে শায়িত রয়েছেন। তাকে ডুয়েল লড়ার সময় নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। যদিও তার বাবা টাকা-পয়সা খরচে কোনো কার্পণ্য করেনি। এমনকি এই গোল্ডেন বাউ যেটা আফ্রিকান নেভীদের প্রধান যুদ্ধ জাহাজ ছিল সেটাও তার পুত্রের মৃত্যুর চেয়ে। বড় না।