“তাদের সাথে আমার যে কথাবার্তা হতো আমি প্রতিনিয়ত তার প্রোগ্রেস রিপোর্ট পেশ করতাম,” পেট বলতে লাগল। কিন্তু এখন যেহেতু তাদের সাথে ব্যাপারটা শেষ হয়ে গিয়েছে, তাই আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিরেক্টর-এর কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করতে হবে।”
‘বুঝতে পেরেছি। জন কোম্পানির যত দ্রুত সম্ভব সব কিছু জানা দরকার, তাই তো? আমার তো মনে হয়, তোমার জন্য সসেজ-এ একটা শোয়ার মতো বেঞ্চের ব্যবস্থা করতে হবে।”
অন্যমনস্কতার কারণে কথাটা বুঝতে পারলো না পেট। “আমি দুঃখিত ক্যাপ্টেন। সসেজ কী? আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি।”
গোডিংস হাসতে হাসতে বলল, “ওহ্! দুঃখিত। আমি ভেবেছিলাম তুমি জানো। কাম্বারল্যান্ড জাহাজের অপর নাম এটা। তারা এখানে সসেজ বানায়। আমি নিজে একজন ডেভোনশায়ার-এর লোক। যাই হোক এই কারণেই আর্ল অফ কাম্বারল্যান্ড-এর নাম সসেজ। আমি খুব অবাক হলাম যে, কোম্পানির লোক হিসেবে তুমি এটা জান না।”
“আসলে আমি সবসময় অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ছিলাম। কিন্তু আপনার আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ। আমি খুবই খুশি হব যদি জাহাজে একটা বেঞ্চ পাই। আর যাত্রার খরচ বহন করার মতো টাকা আমার কাছে আছে। ষাট গিনিতে হবে না?”
“অবশ্যই হবে”, গোডিংস বলল এবং নিজে নিজে ভাবতে লাগল যে মি. পেট-এর ব্যাপারে কোম্পানির আরও মনোযোগ দেয়া উচিত। তাকে আরও সুযোগ সুবিধা দেয়া উচিত। “উপরে চল।”
পেট হাসল, সে মনে মনে ভাবছে, গোডিংসকে খুন করার জন্য তাকে যে পাঁচশ গিনি অফার করা হয়েছে সেটা উপার্জন করা এখন কতই না সহজ হয়ে গেল! অনেক নির্বোধ লোককে পেট যেরকম দেখেছে গোডিংসও তার ব্যতিক্রম নয়-সেও নিজেরই নির্বুদ্ধিতার শিকার। এরকম অজ্ঞতা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয় যা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। গোডিংস মনে করছে যে ডিরেক্টর-এর অল্পবয়সি সুন্দরী বউ-এর সাথে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে সে ডিরেক্টরকে ধ্বংস করতে পারবে, কিন্তু দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে সে বুঝতে পারবে যে কত বড় ভুল সে করেছিল।
আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এর একেবারে উপরে উঠে পেট তার কাজ শুরু করার আগে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। সমুদ্রের ওপর দিয়ে কিভাবে চলতে হয়, কিভাবে নিজের ভারসাম্য রাখতে হয় এটা তাকে আরও ভালভাবে শিখতে হবে। জাহাজটা কিভাবে বানানো হয়েছে, কোথায় কোনটা আছে সেটা আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে হবে। বন্ধুত্ব, বৈবাহিক সম্পর্ক এবং জানা অজানা শত্রুর ব্যাপারে তাকে আরও সচেতন হতে হবে। এই সম্পর্কগুলো যাতে কোনোভাবে তার কাজে ব্যাঘাত না ঘটায়। সর্বোপরি, সে অদৃশ্য এক সংকেত এর জন্য অপেক্ষা করছে, যে সংকেত ছাড়া সে হত্যা করতে পারবে না। স্বর্গীয় এ সংকেত তার মস্তিষ্কে প্রেরিত হলেই সে বুঝতে পারবে যে তার হত্যা করার সময় এসেছে। ওর মাথার ভেতর যে লোকটি কথা বলেছিল, সে তাকে বলেছিল, যেই লোকটিকে তার হত্যা করতে হবে, তার মতো লোকের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই। স্বর্গীয় কণ্ঠটা এও বলেছিল যে, সে যদি এই লোকটিকে হত্যা করে তবে সে দুনিয়া থেকে কিছু পাপ মুছে ফেলতে পারবে।
পেট এখন প্রতিরাতে কেবিনের উপরের পাটাতন থেকে ঝুলন্ত এক কাঠের দোলনায় ঘুমায়। জাহাজ নড়াচড়ার সময় সে যাতে পড়ে না যায় এ কারণেই সে এরকম ব্যবস্থা করে নিয়েছে। এখন সে তার দোলনার ন্যায় বিছানায় হাঁটুগেড়ে বসে ধ্যানমগ্ন হয়েছে। কারণ সে জানে যে সমস্ত ফেরেশতা এবং স্বর্গীয় দূতেরা সবসময় তার কাজকর্ম দেখাশোনা করছে। ধ্যানরত অবস্থা যতক্ষণ তার মধ্যে এই অলীক দৃষ্টি স্থায়ী হয়, ততক্ষণ সে এক ধরনের আনন্দ অনুভব করে যে আনন্দ সে কোনো নারীর সঙ্গের চেয়েও বেশি উপভোগ করে। যখন সে এই দৃষ্টি থেকে জেগে উঠে, তার মন এক ধরনের স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ভরে থাকে এই ভেবে যে সে তার সৃষ্টিকর্তার জন্য কাজ করছে।
সে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে সামান্য একটা ছুরি, যেটা সে গোডিংস আর তার সিনিয়র অফিসারদের সাথে রাতের খাবার খাওয়ার সময় তুলে নিয়েছে। ছুরিটাকে সে আবার শান পাথর দিয়ে ধারালো করে নিয়েছে, তাই এখন এটাকে আর সামান্য ছুরি বলা যায় না। বরং এটাকে এখন ড্যাগার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এই শান পাথরটা সে জাহাজের একটা স্টোর রুম থেকে নিয়েছে। যখন পেট গোডিংসকে ছুরি দিয়ে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ঠিক তখনই সে একটা ফন্দি এঁটেছিল। গোডিংস-এর সাথে জাহাজের এক কর্মচারীর সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল তার দুর্ব্যবহারের কারণে। সে যদি এরকম একটা ছুরি দিয়ে গোডিংসকে খুন করে তবে খুব সহজেই এর দায়ভার ওই কর্মচারীর ওপর বর্তাবে। কারও মনে সন্দেহ থাকবে না যে ওই কর্মচারী প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই এই কাজ করেছে। তার পক্ষে একটা কথা বলার মতো কোনো বন্ধুও বেচারা খুঁজে পাবে না। পেট সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে নিজেই ঐ বেচারার পক্ষ নিয়ে কথা বলবে। তবে সেটা পরের ব্যাপার সে তার ডান পকেটে ছুরিটা রেখে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এল, এরপর হেঁটে গিয়ে ক্যাপ্টেন-এর দরজায় কড়া নাড়ল।
“ভেতরে এসো”, গোডিংস ডাক দেয়। জাহাজের ভেতর ভিন্ন সংস্কৃতির দুজন মানুষের সন্ধ্যাবেলা ব্রান্ডি পান করতে করতে গল্প করাটা তার কাছে অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার বলে মনে হয় না। সেই সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্তরোত্তর সাফল্য এবং সম্পদ বৃদ্ধির কথা নিয়ে গল্প করাটাও তার কাছে সঠিক বলেই মনে হয়।