“এখন এসব থাক মহারাজা, আমার মনে হয় না…” যাজক বলতে শুরু করল। কিন্তু ছোট্ট মহারাজার সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ জেনারেল নাজেত-এর দিকে। নাজেত ছেলেটির খুব কাছে চলে এল, এরপর হাত দিয়ে টেনে জড়িয়ে ধরল।
আইয়াসু দ্বিতীয় বারের মতো জেনারেল নাজেত-এর কাছে গেল। কিন্তু এবার আর রাজা হিসেবে নয়, একজন সন্তান যেভাবে মায়ের কাছে যায়, ঠিক সেভাবে গেল।
“আমি আপনার পাশেই আছি,” নাজেত ওকে বোঝাতে শুরু করল “কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার যখন ইচ্ছে হবে আপনি কার্টনির জাহাজ দেখতে চলে আসবেন। কী আসবেন না?”
ছোট্ট বালক জোরে জোরে হা-সূচক মাথা ঝাঁকাল।
“আপনি চাইলে কামানের গোলাও ফোঁটাতে পারেন। আপনার ভালই লাগবে,” নাজেত আবার বলল।
নাজেত টের পেল যে আইয়াসু তার কাঁধে মুখ গুঁজে রাখা অবস্থায় মাথা নাড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে আইয়াসু তার মাথা সোজা করল, এরপর খুবই ক্ষীণ স্বরে বলল, “তুমি ক্যাপ্টেন কার্টনির সাথে অনেক দূরে ভেসে যাবে তাই না?”
“হ্যাঁ, মহারাজা, আমাকে যেতে হবে।”
“প্লিজ, যেও না।” সে বলল, তারপর সে দৃঢ় কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, “আমি তোমাকে আদেশ করছি তুমি যাবে না। তোমাকে আমার আদেশ মানতে হবে। তুমি বলেছিলে মানবে।”
এরপর ছোট্ট মহারাজা আরেকবার কাঁদতে কাঁদতে নাজেত-এর কাঁধ জড়িয়ে ধরল। পাদরী এক-পা এগিয়ে এল তার ছোট্ট সাহেবটাকে বাধা দিতে। কিন্তু নাজেত তাকে হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিল। “এক সেকেন্ড বিশপ, আমাকে এর সমাধান করতে দিন।”
সে আইয়াসুকে খানিকক্ষণ কাঁদতে দিল। কিছুক্ষণ পর সে তার চোখের পানি এবং নাক মুছে দিল। এপর সে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, “আপনি জানেন আপনাকে আমি অনেক পছন্দ করি। তাই না মহারাজা।”
“এখন আমি যেখানেই যাই, যত দূরেই যাই, আমি সব সময় আপনাকে মনে রাখব। আপনার কথা ভাবব। এখন মনে করুন আমি যদি ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স এরকম দূরের কোনো দেশে যাই তাহলে আমি অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস দেখতে পাব। আর যদি আমি দেখতে পাই তাহলে সেগুলো সম্পর্কে আপনাকে লিখে জানাতে পারব।”
“তুমি আমাকে কথা দাও যে তুমি আমাকে চিঠি লিখবে।”
“একজন সৈনিক হিসেবে আমি আমার মহারাজাকে কথা দিচ্ছি।”
“আর যদি আমি ক্যাপ্টেন কার্টনির জাহাজে যাই তাহলে সে কী আমাকে কামানের গোলা ফোঁটাতে দেবে?”
“আমি তাকে আদেশ করব। আমি জেনারেল আর সে সামান্য ক্যাপ্টেন মাত্র। আমার আদেশ তাকে মানতেই হবে।”
মহারাজা আইয়াসু কিছুক্ষণ চিন্তা করল, এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর সে জুডিথ-এর দিক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “বিশপ ফেসিলাইডস, আপনি কী দয়া করে জেনারেল জুডিথ নাজেতকে বলে দিবেন যে আমি তাকে যাবার অনুমতি দিয়েছি?”
*
আর্ল অফ কাম্বারল্যান্ড জাহাজটির নামকরণ করা হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম গভর্নর-এর নামানুসারে যারা ইস্ট ইন্ডিস-এর লোকদের সাথে বাণিজ্য করেছিল। জাহাজটি চল্লিশ দিন পূর্বে বোষে (মুম্বাই) থেকে ছেড়ে যায় ১০০ টন খনিজ পদার্থ নিয়ে। লন্ডনের বন্দরে গিয়ে এটি নোঙর ফেলবে। সেখান থেকে খনিজ পদার্থগুলো নিয়ে যাওয়া হবে গ্রীনিচ প্যালেস-এর অস্ত্রাগারে। সেখানে এই মিনারেলগুলো সালফার ও কয়লার সাথে মিশিয়ে গান-পাউডার তৈরি করা হবে। সেই গান পাউডার সরবরাহ করা হবে চার্লস-টু-এর আর্মি এবং নেভীতে।
জাহাজের পেছন দিকে যেখানে ক্যাপ্টেন-এর থাকার ঘর সেখানে আরও কিছু কেবিন রয়েছে সিনিয়র অফিসার এবং গুরুত্বপূর্ণ যাত্রীদের থাকার জন্য। এরকমই একটা কেবিনে এক লোক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে দুই হাত জড়ো করে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছে।
তার নাম উইলিয়াম পেট। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিনিয়র অফিসার হিসেবে সমস্ত কাগজপত্র সে সাথে করে নিয়ে এসেছে, ফলে কোম্পানির কাজে কোম্পানির যে-কোনো কর্মচারী তাকে সাহায্য করতে বাধ্য থাকবে।
বোম্বের (মুম্বাইর) প্রথম গর্ভনর জেরাল্ড আংগিয়ার-এর আমন্ত্রিত এক ডিনারে পেট আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এর নাবিক ক্যাপ্টেন রুপার্ট গোডিংস-এর সাথে আলোচনায় মগ্ন রয়েছে। সে এখন তাকে ব্যাখ্যা করছে যে ইন্ডিয়ায় তার কাজকর্ম সমাপ্ত হয়েছে। কাজটা অনেক সূক্ষ্ম এবং কঠিন ছিল, বিশেষ করে প্রসিদ্ধ ইন্ডিয়ান এবং পর্তুগীজ লোকদের সাথে উঠাবসা করা, টাকা-পয়সা আদান-প্রদান করা। যদিও এ ব্যাপারে খুব খোলামেলা আলাপ করার স্বাধীনতা তার নেই।
“পৃথক হয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাটা আশা করি বুঝতে পেরেছেন,” পেট অন্য লোকটির মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল।
গোডিংস খুব লম্বা মোটাসোটা, উচ্ছ্বসিত এবং আত্মবিশ্বাসী মানুষ। তার নাকের নিচে কালো ঘন গোঁফ বেঁকে ঠোঁটের কোণ থেকে একটু উপরে উঠে গিয়েছে। এই গোফের কারণে তাকে আরও তরুণ লাগছে এবং প্রকৃত বণিক হিসেবে তার সমাদর বেড়েছে। তাকে একজন দক্ষ নাবিকই বলা যায়। এটার কারণ তার অসীম সাহসিকতা এবং বুদ্ধিদীপ্ত মনোভাব। যদিও তার কাছের বন্ধুরা এটা মেনে নিতে নারাজ। লোকটা তার চেহারায় খুব চিন্তিত একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে জবাব দিল, “অবশ্যই, অবশ্যই…আমার মতে পর্তুগীজ এবং ইন্ডিয়ানরা খুব একটা সুবিধার না। এরা হচ্ছে সুস্বাদু খাবারের মতো। কিছু সময়ের জন্য রক্ত গরম করে।”–