তাবুর মাঝখানে টেবিলের ওপর যুদ্ধক্ষেত্রের একটা মডেল বা মানচিত্র রাখা আছে। পাহাড়, নদী, হ্রদ সমুদ্র, ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী মডেলের নির্দিষ্ট জায়গায় এগুলোকে দেখানো হয়েছে। আইভরি পাথর দিয়ে তৈরি অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত যে সৈন্য, অশ্বারোহী এবং ছোট ছোট কামান-এর মডেল এখানে দেখানো হয়েছে সেগুলো দ্বারা যথাক্রমে পদাতিক বাহিনী, অশ্বারোহী এবং আর্টিলারি ইউনিটকে বোঝানো হয়েছে। দিনের শুরুতে মডেলগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্রে দুই বাহিনীর অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছিল, কিন্তু এখন আরব সৈন্যদের সংখ্যা কমতে কমতে টেবিল থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
তাঁবুর পরিবেশ এখন বেশ শান্ত রয়েছে। লম্বা আলখাল্লা পরিহিত একজন যাজক সিনিয়র এক অফিসারের সাথে ঠাণ্ডা আলোচনায় মশগুল রয়েছেন। তার ধূসর রঙের দাড়ি হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে, গলায় শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন মণিমুক্তা খচিত পুঁতির মালা ও মেডেল। লোকটির মৃদু মন্থর গলার স্বর টেবিলের আশপাশ থেকে আসা উত্তেজনার মাঝেও আলাদাভাবে বোঝা যাচ্ছে।
“ব্যাং! ব্যাং! টেইক দ্যাট!” একটা ছোট ছেলে চিৎকার করে উঠল। তার হাতে ইথিওপিয়ান যোদ্ধার একটি ছোট্ট মূর্তি যেটা স্ট্যালিয়ন-এর ওপর বসে ছিল। ছেলেটা মূর্তিটাকে একবার টেবিলের একপাশে, পরমুহূর্তে আবার অন্যপাশে নিয়ে যাচ্ছে। এখনো যে সব আরব সৈন্যের মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুলোকে ছোট্ট স্ট্যালিয়ন আরোহীর সাহায্যে ফেলে দিচ্ছে সে।
গার্ড তাবুর প্রবেশ পথের পর্দাটা সরিয়ে দিলে একজন সৈন্য সামনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল যার ইউনিফর্মে বুকের ওপর সাদা রঙের লিলেন কাপড় ও বিভিন্ন ধাতব চেইন লাগানো রয়েছে বিভিন্ন ভাবে। এগুলো দেখেই বোঝা যায় যে কোনো রকম নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে এগুলো পরানো হয়নি। অন্য কোনোরকম বিশেষত্ব আছে এগুলোর।
“জেনারেল নাজেত!” ছোট্ট ছেলেটি চিৎকার করে উঠল। এরপর ছেলেটি তার খেলনা সৈন্যটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে আগন্তুকের ধাতব পোশাক পরিহিত পা জড়িয়ে ধরল-যে পোশাকে এখনো শত্রুর রক্তের ছিটেফোঁটা লেগে আছে। সেও ছোট্ট ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল যে দেখে মনে হচ্ছিল, ছেলেটি তার মায়ের নরম আলিঙ্গনে রয়েছে।
জেনারেল তার মাথা থেকে হেলমেটটি সরিয়ে ফেললে ঘন কালো কোকড়া চলগুলো বের হয়ে এল। জেনারেল যখন তাঁর মাথাটা এদিক ওদিক নাড়া দিল, তার কোকড়া চুলগুলো প্রাণ ফিরে পেয়ে আন্দোলিত হতে লাগল। মোমবাতির আলো যখন তার কোঁকড়া চুলগুলোর ওপর পড়ল, তখন দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্বর্ণালি আভা বিকিরিত হচ্ছিল ওখান থেকে। তার চেহারাই বলে দিচ্ছিল যে যুদ্ধের ক্লান্তি বা বিষণ্ণতা কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
নতস্বরে বলা শুরু করল সে, “ইউর মেজেসটি, আপনাকে অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে আমাদের বিজয় সম্পন্ন হয়েছে। শত্রু ভূপাতিত হয়েছে, সেই সাথে তাদের বাকি সৈন্যগুলো পালিয়েছে।”
ক্রিশ্চিয়ান অধিপতি, রাজাদের রাজা, গালা ও অ্যামহারার স্বত্বাধিকারী এবং খ্রিস্টীয় ক্রুসিফাইড-এর প্রতিরক্ষাকারী আইয়াসু, জেনারেল-এর পা ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল, এরপর আনন্দের আতিশয্যে উপরে-নিচে লাফাতে লাগল, সেই সাথে চিৎকার করতে লাগল। মিলিটারির সদস্যরা এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক এবং কাঁধে মৃদু চাপ দেয়ার মাধ্যমে তাদের কমরেডকে ভাবগাম্ভীর্যতার সাথে অভিবাদন জানাল, একই সাথে সেখানে উপস্থিত যাজক হাত তুলে তাকে আশির্বাদ করল।
জেনারেল নাজেত শান্তভাবে মৃদু হাসি দিয়ে সবার ধন্যবাদ ও অভিনন্দন গ্রহণ করল। “মহারাজ, এখন আমি আপনার কাছে কিছু একটা চাইব। এর পূর্বে আমি কমান্ডার হিসেবে আপনার বাহিনী থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার দেশ এবং আমার রাজ্যের টানে তখন আমি যেতে পারিনি। আমার বিবেক তখন আমাকে যেতে দেয়নি। তাই তখন আমি সৈনিকের পোশাক পরে অস্ত্র কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু মহারাজ, আমি শুধুই একজন সৈন্যই নই, একজন স্ত্রীলোকও বটে, যে একজন পুরুষের আমানত। সে তখন আমাকে আপনার আদেশ পালন করার অনুমতি দিয়েছিল। আর এখন, আমি আপনার কাছে অনুমতি চাইছি তার কাছে ফিরে যাবার।”
ছেলেটি তার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ ভ্রুকুটি করে চিন্তা করার পর বলল, “সেই লোকটি কী ক্যাপ্টেন কার্টনি?”
“হ্যাঁ, মহারাজ”, জুডিথ নাজেত জবাব দিল।
“গাছের পাতার মতো সবুজ রঙের চোখওয়ালা সেই ইংলিশ লোকটা?”
“ইয়েস, ইউর মেজেসটি। আপনার কী মনে আছে তার সাহস ও কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আপনি তাকে ‘গোল্ডেন লায়ন অফ ইথিওপিয়া হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ, আমার মনে আছে” চেহারায় একটা অপ্রত্যাশিত দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে আইয়াসু জবাব দিল। এরপর সে আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী মাম্মি এবং ড্যাডি হতে যাচ্ছ?” ছোট্ট বালক রাজা ঠোঁটের ওপর ঠোঁট তুলে মুখ বাকা করে বোঝার চেষ্টা করল কেন সে এত কষ্ট পাচ্ছে। হঠাৎ কেনই বা তার এত দুঃখ লাগছে। এরপর সে আবার বলল, “আমার যদি একটা মাম্মি এবং ড্যাডি থাকত। যদি তুমি এবং ক্যাপ্টেন কার্টনি চলে এসে প্রাসাদে থাক তাহলে আমি একটা মাম্মি এবং একটা ড্যাডি পেতাম।”