“তোমার নাম কী?” আহত লোকটি জিজ্ঞেস করল।
“এলথুদা, স্যার!”
“আচ্ছা, ঠিক আছে এলথুদা, তুমি এই হারামজাদা শয়তানটাকে বল যে আমি ওমান-এর রাজা আহমেদ এল গ্রেং এবং গ্রেট মোগল-এর ছোট ভাই মহারাজা সাদিক খান জাহান-এর সহযোদ্ধা ছিলাম। আমি তাদের জন্য যা করেছি তারা দুজন অবশ্যই সেটার মূল্য দিবে। তারা যদি জানতে পারে যে সামান্য একজন বৃদ্ধ শল্যচিকিৎসক আমার কথা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তবে সে তার যথার্থ প্রাপ্যটাই পাবে। ওকে তুমি শেষবারের মতো বল, সে যাতে আমাকে একটা আয়না এনে দেয়।”
উত্তেজিত হয়ে এতক্ষণ কথা বলার পর লোকটি আরও ক্লান্ত হয়ে গেল। বালিশের ওপর মাথাটি ছেড়ে দিয়ে সে দেখতে লাগল যে তার কথাগুলো ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলা হচ্ছে কি-না। সে দেখল কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তারের আচরণ হঠাৎ করেই বদলে গেল। সে মাথা নিচু করে বিছানায় শোয়া লোকটিকে কুর্নিশ জানাল, এরপর তৃরিত গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, তারপর উজ্জ্বল ফ্রেম-এ বাধাই করা একটা বড় গোলাকার আয়না নিয়ে ফেরত এল। আয়নাটি বেশ বড়, তাই সে এলথুদাকে সাহায্য করতে বলল, যাতে আয়নাটা আড়াআড়িভাবে বিছানার ওপর শোয়া লোকটির মুখের সামনে ধরা যায়।
আয়নায় নিজের চেহারা দেখার পর কয়েক মুহূর্তের জন্য লোকটি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। উঠে যাওয়া বাম চোখের আইরিশ মরে একেবারে নীল হয়ে গিয়েছে। এর চারপাশে থকথকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। বাম চোখের নিচের গাল-এর চামড়া ও মাংস এমনভাবে পুড়ে গিয়েছে যে দাঁত ও ম্যান্ডিবল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ডান কানের উপরে চুল পুড়ে কুঁকড়ে গিয়েছে। মাথার কিছু অংশের চামড়া পুড়ে গাছের খোলসের মতো উঠে গিয়েছে। তাকে দেখতে অনেকটা পচে যাওয়া মৃতদেহের মতোই লাগছে। কিন্তু এরপরেই লোকটা আপনমনে ভাবতে লাগল-তাকে দেখতে আর কেমনই বা লাগা উচিত যেখানে তার বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না? অথচ এক সময় সে জীবনের ওপর দিয়ে ছড়ি ঘুরিয়ে বেঁচে ছিল। যখন যা মন চাইত তাই করত। আনন্দে ডুবে থাকত সবসময়। মদ খেত, জুয়া খেলত, ফুর্তি করত, যুদ্ধ করত। কিন্তু এখন সবকিছু তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। তার শরীর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তার হৃদপিণ্ড কবরের মতো নীরব হয়ে গিয়েছে। যদিও এখনও সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। তার ভেতরে এখনও একটা শক্তি কাজ করছে যেটা তাকে আরো একটিবার উঠে দাঁড়াতে এবং সমস্ত কিছুর প্রতিশোধ নিতে ক্রমাগত প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে।
লোকটি এলথুদার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমার নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু তুমি কী আমার নাম জান?”
“না, স্যার।”
লোকটির থেতলে যাওয়া মুখে এক ধরনের হাস্যকর মুখভঙ্গি ফুটে উঠল। “তাহলে তো তোমাকে আমার নাম বলতেই হয়। আমি অ্যাংগাস কোকরান। একজন গর্বিত স্কটম্যান। আমার উপাধি ছিল আর্ল অফ কুম্বা।”
এলথুদার চোখ এত বড় বড় হয়ে গেল যে সে যেন ভয়ঙ্কর কিছু দেখছে। “আপনি… আপনিই সেই ব্যক্তি যাকে বুজার্ড নামে ডাকা হতো।”
“হ্যাঁ, আমিই সেই ব্যক্তি। তুমি যদি সেটা জান তাহলে নিশ্চয়ই এটাও জান যে, আমার এই অবস্থার জন্য কে দায়ী। হাল কার্টনি নামে এক ইংরেজ যুবক। আ-হা…! তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি যে তুমি আমাকে ভালভাবেই চিনতে পেরেছ, তাই না?”
“হ্যাঁ, স্যার।”
“আমি তোমাকে আরও বলে রাখি, যেভাবেই হোক এই হাল কার্টনিকে আমি খুঁজে বের করবই। সে যেখানেই থাকুক আর আমাকে যত দূরেই যেতে হোক। আমি তাকে ধ্বংস করেই ছাড়ব। তার রক্তে আমি আমার ঠোঁট রাঙাব।”
*
উত্তর-পূর্ব ইথিওপিয়ার কেবাসা ভূমির সর্বত্র যুদ্ধের ধামামা ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্য উঠার পর থেকে দিনের শেষ আলোকরশ্মিটি দেখা না যাওয়া পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ চলেছে। এখন যুদ্ধের ধামামা থেমে গিয়েছে, কিন্তু তার বদলে বিজয়ীদের হর্ষধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সেই সাথে বাতাসে ভেসে আসছে পরাজিত শত্রুদের ক্ষমা প্রার্থনার আর্তনাদ। আহত যযাদ্ধাদের হাহাকার ধ্বনিত হচ্ছে সর্বত্র। ক্রিশ্চিয়ান ইথিওপিয়ান সৈনিকেরা তৃতীয় বারের মতো মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এই যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে গ্রেট মোগল-এর নির্দেশেই। প্রথম দু’বারের যুদ্ধে তারা জিতলেও ওগুলোতে তাদের ভিত নড়ে উঠেছিল, সেই সাথে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই শঙ্কা জেগেছিল তাদের মনে। কিন্তু এবারের বিজয় তাদের কাছে পরিপূর্ণতা নিয়ে হাজির হয়েছে। শত্রু ঘটির মূলোৎপাটন করা হয়েছে। অস্ত্র-সরঞ্জামসহ যেসব রণতরী ইরিত্রিয়ান উপকূল দিয়ে রেড সী অতিক্রম করতে চেয়েছিল সেগুলোকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এ কাজের নেতৃত্ব দিয়েছে গোল্ডেন বাউ নামক ইংরেজদের জাহাজ। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই গোল্ডেন বাউ সাগরে ভাসানো হয়েছিল। কিন্তু এর ক্যাপ্টেন জাহাজটাকে স্বাধীনতা রক্ষা, ইথিওপিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ বা সম্পদ এবং খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী দেশসমূহকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে টেবারনেও রয়েছে সেখানে যিশু খ্রিস্ট মাউন্ট জিউন থেকে পাথর এনে রেখেছিল এবং ধারণা করা হয় হলি গ্রেইলও সেখানে রাখা আছে।
ইথিওপিয়ান লাইনের পেছনে বিশাল এক তাবু গড়ে উঠেছে। ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ ও বর্ম পরিহিত এক দল সৈনিক এটার প্রবেশপথ পাহারা দিচ্ছে। তাঁবুর ভেতরে ট্যাপেস্ট্রিতে খ্রিস্টের জীবনী সমৃদ্ধ বিভিন্ন দৃশ্য শোভা পাচ্ছে। বিভিন্ন রঙের সিল্কের সুতা দিয়ে এগুলো বোনা হয়েছে। অসংখ্য মোমবাতি ও মশালের আলোতে ওগুলো চকচক করছে।