মনে হচ্ছে জাহান একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছেন-যে ব্যক্তির পুরো শরীর আগুনে পুড়ে গিয়েছে, যার এক হাত বাহু পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়েছে, সেই সাথে উপড়ে নেয়া হয়েছে একটি চোখ, দীর্ঘসময় ধরে যে মানুষটা পানিতে ডুবেছিল, এবং অবশেষে বালুকাবেলায় দুইজন কিশোর কর্তৃক আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত যে ব্যক্তি দিনের পর দিন তীব্র রোদে পুড়ে দগ্ধ হয়েছিল, তার বেঁচে থাকার পেছনে অবশ্যই স্বর্গীয় হাত রয়েছে।
ডাক্তারকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই রোগী বেঁচে গেলে তাকে তার ধারণার চেয়েও বেশি পুরস্কার দেয়া হবে কিন্তু রোগী যদি মারা যায় তবে তার শাস্তিটাও এর চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না। সে তার এই দীর্ঘ ডাক্তারি জীবনে বহু রোগীকে তাদের সীমাহীন কষ্ট থেকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু এটা অন্য সব কিছুর চেয়ে আলাদা। রোগীটিকে বেঁচে থাকতে হবে। আর এটা অবশ্যই ডাক্তারকে নিশ্চিত করতে হবে।
লোকটি আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে যে চারপাশের আলোকিত জগৎ সে অনুধাবন করতে পারছে না। শুধু ডাক্তার যখন ব্যান্ডেজ খোলার চেষ্টা করছে তখন সে কেবল কয়েকটা আলোকরশি দেখতে পাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে আরো বুঝতে পারছে, যে আলোক রশিাগুচ্ছ তার মস্তিষ্কে যাচ্ছে, সেগুলো আসছে ডান চোখ দিয়ে, বাম চোখ দিয়ে নয়। তার বাম চোখ পুরোপুরিই অন্ধ। কিন্তু তার মনে হচ্ছে বাম চোখটি এখনো চোখের জায়গাতেই রয়েছে। ওখানকার স্নায়ুগুলো এখনো চোখের অস্তিত্বকে ভুলতে দিচ্ছে না। সে চোখের পলক ফেলতে চাচ্ছে কিন্তু শুধু ডানচোখের পাতাই কেবল তার সে ইশারায় সাড়া দিচ্ছে। বাম চোখ মোছার জন্য সে তার বাম হাতটি উঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাম হাতটিও হাতের জায়গায় নেই। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে ভুলে গিয়েছিল যে সে তার বাম হাতটিও চিরতরে হারিয়েছে। চোখের স্নায়ুগুলোর মতো হাতের স্নায়ুগুলোও একই রকম চুলকানির মতো অনুভূতি মস্তিষ্কে নিয়ে যাচ্ছে। একারণেই তার মনে হচ্ছে যে বাম হাতটি এখনো হাতের। জায়গায়ই রয়েছে। সে তার ডান হাতটি উঠানোর চেষ্টা করে কিন্তু শুষ্ক ও শক্ত কোনো হাত তার ডান হাতটি ধরে রেখেছে। সে ডাক্তারের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু ডাক্তার কি বলছে তার একটি কথাও সে বুঝতে পারছে না।
সে বুঝতে পারল তার ডান চোখের ওপর কেউ একজন ঠাণ্ডা কিছু একটা চেপে ধরে আছে এবং আস্তে আস্তে তা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। যখন এটা উঠিয়ে ফেলা হল, সে তার দৃষ্টিশক্তি আস্তে আস্তে ফিরে পেতে শুরু করল। সে খোলা জানালা দেখতে পেল। জানালার পেছনে খোলা আকাশ দেখতে পেল। সে আরও দেখতে পেল সাদা রঙের আলখাল্লা ও পাগড়ি পরিহিত একজন বয়স্ক লোক তার পাশে বসে আছে, যে কি-না এক হাত দিয়ে ব্যান্ডেজ খোলার চেষ্টা করছে এবং অন্য হাত দিয়ে তা সরিয়ে নিচ্ছে।
এছাড়াও কামরার মধ্যে অন্য একজন লোক রয়েছে। একজন অল্পবয়স্ক যুবক ডাক্তারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারা, গায়ের রঙ সব ইস্ট ইন্ডিস-এর লোকদের মতো। কিন্তু তার পোশাক পরিচ্ছদ, স্টাইল সব ইউরোপিয়ানদের মতো। তার বংশে হয়ত কোনো সাদা রক্তের মিশ্রণ রয়েছে। তার গায়ের রঙে এশিয়ানদের বাদামি বর্ণের সাথে ধূসর গোলাপি রঙের আমেজ মিশে গিয়েছে।
বিছানায় শোয়া রোগীটি যুবক ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি কী ইংরেজি বলতে পার?”
তার একটা শব্দও বোঝা যাচ্ছিল না শুধু ফিসফিস আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। সে তার ডান হাত দিয়ে ইশারা করে ছেলেটিকে আরও কাছে যেতে বলল। ছেলেটিও খুব সতর্কতার সাথে তা করল।
“তুমি ইংরেজি বলতে পার?” বিছানায় শোয়া রোগীটি আবার বলল।
“হ্যাঁ স্যার, আমি পারি।”
“তাহলে এই ব্যায়াদব আরব লোকটাকে বল…” সে আবারো নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য থামল। মনে হচ্ছে যেন তার বুকের খাঁচা বাতাসের অভাবে চুপসে গিয়েছে। … যাতে সে আমার ব্যান্ডেজ উঠানোর সময় এত আলগা দরদ না দেখায়…” লোকটা আবার থামল নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য। মনে হল সে ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। “…যত দ্রুত সম্ভব এই জঘন্য জিনিসগুলো সরাতে বলল ওকে…”
কথাগুলো আরবিতে ডাক্তারকে বুঝিয়ে বলা হল। ফলে ডাক্তারের ব্যান্ডেজ খোলার গতি আরও দ্রুত হল। সে খুব তাড়াতাড়ি শক্ত হাতে ব্যান্ডেজ খুলতে লাগল।
যদিও ব্যথা বাড়ছে, কিন্তু বিছানায় শোয়া লোকটি তার এই মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে একধরনের পাশবিক আনন্দ নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে নিজেকে বোঝাল যে এটাও একটা বাধা। সমুদ্র বা বাতাস এর সাথে এটার কোনো পার্থক্য নেই। এই বাধাটাকেও দমন করে তার আয়ত্তে আনতে হবে, কোনোভাবেই এটার কাছে হেরে যাওয়া যাবে না। তার শরীর থেকে রক্তমাখানো ব্যান্ডেজ-এর শেষ তন্ত্রটা উঠানোর আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করল সে। এরপর বলল, “তাকে বল আমার সামনে একটা আয়না নিয়ে আসতে।”
ডাক্তারের পেছনে দাঁড়ানো ছেলেটি অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল। সে ডাক্তারকে কথাটা জানাল। ডাক্তার মাথা ঝাঁকাল, এরপর অস্পষ্ট এবং উচ্চস্বরে খুব দ্রুত কিছু একটা বলতে লাগল। যুবক ছেলেটি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে ডাক্তারকে বোঝনোর চেষ্টা করল। কিন্তু কোনো লাভ হল না।
অবশেষে সে বিছানার কাছে এসে লোকটিকে জানিয়ে দিল, “স্যার, সে বলেছে যে সে এটা করতে পারবে না।”