অবশেষে মহিলাটি লোকটার গলা থেকে কাস্তে সরিয়ে নিল।
মহিলাটি জিজ্ঞেস করল, “তাহলে…আমরা এখন তাকে নিয়ে কী করব?”
নানী বলল, “আমরা তাকে গ্রামের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”
মহিলাটি বলল, “কীভাবে?”
“আমরা তাকে ছেঁড়া পালটার ওপর চিৎ করে শুইয়ে দেব-” নানী ভাঙ্গা মাস্তুলের সাথে লাগানো পালের দিকে ইঙ্গিত করল। এবং বলল, “এরপর ওটা দুদিক দিয়ে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাব।” এরপর সে তার নাতীদের দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদুরা, অবশ্যই এ কাজে আমাদের সাহায্য করবে, তাই না?”
যুদ্ধাহত মৃত প্রায় লোকটির মস্তিষ্ক চিৎকার করার বার্তা পাঠাচ্ছে। কিন্তু আগুনের শিখা ও ধোয়ায় তার স্বরযন্ত্র এতটাই ঝলসে গিয়েছে যে, সেখান থেকে বাঁশির মতো চিকন আওয়াজ বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন তার গলায় কেউ একজন হারমোনিয়াম-এর ভাঙ্গা বেলোজ (হাপর) বসিয়ে রেখেছে।
অথচ বেশিদিন আগের কথা নয়-প্রায় এক কী দুই মাস আগেও যখন সে সমুদ্রের ঝড়ের দিকে মুখ করে দাঁড়াত, তখন তার দৃঢ় ও শক্ত মুখভঙ্গির কাছে সমুদ্রের বাতাস আর গর্জনও বোধহয় ভয়ে কুঁকড়ে যেত। তীব্র বাতাসও তখন তার কাছে কিছুই মনে হত না। আর এখন যখন খোলা জানালা দিয়ে তার ঘরে জেসমিন সুরভিত উষ্ণ বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে, তার গায়ে কেউ কাঁটা ফুটিয়ে দিচ্ছে। ডাক্তার তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে রোগীর ব্যথা কমানোর চেষ্টা করছে, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। তবুও ব্যথা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সে ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে বারবার। ডাক্তার যখন অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তার মুখ থেকে ব্যান্ডেজ খোলার চেষ্টা করছিল তখন তার মনে হচ্ছিল যেন শক্রর ধারালো ছোঁড়ার আঘাতে সে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছে। এছাড়াও প্রতিমুহূর্তে তার মনে ভেসে উঠছে যুদ্ধের সেই ভয়াবহ স্মৃতি। আগুনের লেলিহান শিখা। গুলির আওয়াজ, কাঠ পোড়ার শব্দ। আহত মানুষের তীব্র আর্তনাদ।
.
“আমি দুঃখিত! কিন্তু এছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই,” ডাক্তারটা বিড়বিড় করে বলল। যদিও যার সঙ্গে সে কথা বলছে সে আরবি ভাষা খুব একটা ভাল বুঝতে পারে না। ডাক্তারের দাড়িগুলো পাতলা ও রুপালি রঙের এবং চোখের নিচে অনেকটা অগভীর গর্ত হয়ে গিয়েছে। সে তার এই পঞ্চাশ বছরের জীবনের সাধনা ও সুনিপুণ নৈপুণ্য দিয়ে যে জ্ঞান অর্জন করেছে তা যে কোনো রোগীকে আশ্বস্ত করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এই রোগীটি ব্যতিক্রম। তার আঘাত এতটাই ভয়াবহ ছিল যে সে বাঁচবে, এই আশা ছেড়েই দেয়া হয়েছিল। তাকে একটা বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছিল পুরোটা সময়। লোকটার একটা বাই পুরোপুরিভাবে শরীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। কেবল পরম করুণাময় আল্লাহই জানেন কিভাবে এটা হয়েছে। একইপাশে বক্ষপিঞ্জরে শক্ত কোনো কুঠার বা অস্ত্র দিয়ে এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে যে, বুকের অনেক হাড় ভেতরের দিকে বসে গিয়েছে। তার শরীরের বেশিরভাগ চামড়া পুড়ে গিয়েছে, সেই সাথে ফোঁসকা পড়ে গিয়েছে পুরো শরীরে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে থেকে যে ফুলের সুবাস আসছে তা এই পুড়ে যাওয়া মাংস, পচে যাওয়া চামড়া ও পুঁজের গন্ধের কাছে মিইয়ে যাচ্ছে।
আগুনে তার হাত-পায়ের চামড়াও পুড়ে গিয়েছে। তার বেঁচে যাওয়া হাতটাতে দুটো আঙুল এমনভাবে পুড়ে গিয়েছে যে বিন্দুমাত্র মাংসও হাড়ের সাথে লাগানো ছিল না। ডাক্তারকে পরে সে অংশটুকুও কেটে ফেলতে হয়েছে। সামুদ্রিক শকুন তার বাম চোখটা উপরে ফেলেছে। অন্য চোখের পাপড়িগুলোও এমনভাবে পুড়ে গিয়েছে যে, সে এখন শীতল দৃষ্টিতে চোখের পলক ফেলা ছাড়াই তাকিয়ে থাকতে পারছে।
কিন্তু দৃষ্টিশক্তি হারানোটাই তার সবচেয়ে বড় ক্ষতি নয়। তার পুরুষাঙ্গ এমনভাবে পুড়ে গিয়েছে যে, সেখানকার চামড়ায় ক্ষতচিহ্ন ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। অর্থাৎ, যদি সে কখনও বিছানা থেকে উঠতে পারে, তবে তাকে মহিলাদের মতো বসে মূত্রত্যাগ করতে হবে। স্ত্রীলোকের সঙ্গম উপভোগ করার কোনো রাস্তাই আর তার সামনে খোলা রইল না।
শুধু উপরওয়ালার ইচ্ছাতেই সে এখনো বেঁচে আছে। ডাক্তার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, তারপর নিজে নিজে মাথা নাড়াল। ব্যান্ডেজ খোলা অবস্থায় ক্ষতটা দেখেই সে আন্দাজ করতে পেরেছিল-আল্লাহ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেন না। তিনি সর্বশক্তিমান ও পরম করুণাময়। এটা নিশ্চয়ই কোনো শয়তানের কাজ। তার পেছনে যে দানবটা লেগেছিল সেটা নিশ্চয়ই কোনো মানুষরূপী শয়তান ছিল। সেই শয়তানটাই নিশ্চয়ই একে এত কষ্ট দিচ্ছে। শয়তানের এই কাণ্ডকারখানা বন্ধ করে দেয়া ডাক্তারের জন্য এক মুহূর্তের ব্যাপার।
ডাক্তারের কাছে এক ধরনের মিষ্টি সিরাপ জাতীয় ওষুধ আছে। সেই ওষুধ যদি রোগীকে খাওয়ানো হয়, তবে তা ব্যথা কমিয়ে দেবে, সেই সাথে ধ্বংস করে দিবে নীরব ঘাতক ব্যাধি। এরপর নারীর কোমল স্পর্শের মতো তার হৃদস্পন্দন চিরতরে বন্ধ করে দিবে। কিন্তু ইথিওপিয়া থেকে মহারাজা সাদিক খান জাহান নিজ হাতে আদেশ লিখে পাঠিয়েছেন যেন এই রোগীকে জানজিবার-এ অর্থাৎ মহারাজার ব্যক্তিগত বাসস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আর সে জন্যই, এই ব্যক্তির বিষেশ যত্ন নেয়ার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে।