“প্লিজ”, জুডিথ আর্তনাদ করতে থাকল, “আমার বেবীকে বেঁচে থাকতে দাও।”
আর ঠিক তখনই সে মাথার পেছনে গরম কিছু একটা অনুভব করল। এক হাত উঠিয়ে সেটা থেকে বাঁচতে চাইলো সে। অয়েল ল্যাম্প-এর কাঁচের ফানেলের স্পর্শ লাগল হাতে, সেই সাথে আগুনের শিখায় হাতের চামড়ার কিছু অংশে ফোঁসকা পড়ে গেল। জুডিথ-এর মনে হঠাৎ করেই একটা আশা জেগে উঠল। সে তেলের পাত্রটা দুই হাত দিয়ে শক্তভাবে ধরে ব্র্যাকেট থেকে ছুটিয়ে আনল। এরপর শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যবহার করে তেলের পাত্রটা দিয়ে বুজার্ড-এর মাথায় আঘাত করে বসলো জুডিথ।
বুজার্ড-এর মাথায় আর সমস্ত শরীরে তেল ছড়িয়ে পড়ল। সাথে-সাথেই ধপ করে আগুন ধরে গেল ওর দেহে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনের শিখা বুজার্ডের চামড়ার মুখোশকে পুড়িয়ে দিয়ে ওর ক্ষতবিক্ষত মুখকে আরো একটিবারের জন্য উন্মোচন করে দিল। পাগলের মতো লাফাতে লাফাতে পেছাতে চেষ্টা করল জুডিথ। একপর্যায়ে বিছানার ওপর হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সে। বিছানার চাদরে আগুন লেগে গেল নিমিষেই। চোখের পলকেই সারা ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ল।
দরজা ফাঁকা পেয়ে দৌড়ে বের হয়ে এলো জুডিথ। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডেকের ওপর চলে এলো সে। খোলা ডেক-এর ওপর এসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার পাশাপাশি ফোঁপাতে শুরু করল ও।
একজোড়া শক্ত বাহু পেছন দিক থেকে এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে সিক্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করল, “ঈশ্বরের দোহাই লাগে, তোমার কী হয়েছে তা কী একটু বলবে? তুমি এভাবে ফোপাচ্ছ কেন?”
জুডিথ ঘুরে দাঁড়াল। হাল দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। সাথে-সাথে হাল এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। “থ্যাংকস গড় যে তুমি এখানে চলে এসেছ! ও আমাকে আর আমার বেবীকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল!”
“কে?”
“বুজার্ড।”
“কোকরান?” “সে এখন কোথায়? তাকে থামাতেই হবে।”
“সে আমাদের কেবিন-এ আছে। কিন্তু জাহাজে আগুন ধরে গিয়েছে। আ…আমি দুঃখিত…এছাড়া তাকে থামানোর আর কোনো রাস্তা ছিল না আমার হাতে…”
হাল আশেপাশে তাকিয়ে বিপদটা বোঝার চেষ্টা করল। সে তাকিয়ে দেখল যে আগত জাহাজটা তাদের জাহাজ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে-যে পথে ওটা এসেছিল, ঠিক সেই পথে।
“ওদেরকে চলে যেতে দাও”, হাল সিদ্ধান্ত নিল। “আগুন কোথায়? তুমি বলছিলে আমাদের কেবিনে।”
জুডিথ দ্রুত মাথা নাড়াল। “হ্যাঁ, সত্যিই। আমাদের কেবিনে।”
হাল জুডিথকে ছাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াল। “অ্যাবোলি! বিগ ড্যান! আগুন লেগেছে! আগুন নেভানোর ব্যবস্থা কর! জলদি!”
.
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পুরো জাহাজের সব পাম্প, সমস্ত নাবিকের শ্রম আর পুরো অর্ধেকটা দিন লেগে গেল। অবশেষে হাল যখন জুডিথকে সাথে নিয়ে কেবিন-এর ভেতরে গেল তখনও ধোয়ার গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। পুড়ে কুকড়ে যাওয়া মৃতদেহটা ওদের সামনেই বিছানার ওপর পড়ে আছে।
“এটা কী বুর্জাড?” জুডিথ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু তাকে দেখতে বেশ ছোট মনে হচ্ছে।”
“আগুন তার এই অবস্থা করেছে। হাল তার বাহু দিয়ে জুডিথকে জড়িয়ে ধরে বলল। “প্রথমবার সে কোকরান হিসেবে পুড়েছিল। এখন সে বুজার্ড হিসেবে পুড়েছে।”
হাল-এর বাহুবন্ধনে মাথা রেখেও কাঁপছিল জুডিথ। তাই হাল তাকে নিয়ে বাইরে বের হয়ে এলো। সিঁড়ি দিয়ে ডেক-এর ওপর উঠতে থাকল সে। সিঁড়ির চুড়ায় বিগ ডেনিয়েল ফিশার অপেক্ষা করছিল।
“আদেশ করুন। ক্যাপ্টেন।”
“প্রথমত” হাল জবাব দিল, “নৌকো থেকে কার্গোগুলো নিরাপদে নামিয়ে জায়গামত রাখ।”
গুপ্তধনের কথা বলায় সাথে-সাথে বিগ ডেনির মুখে হাসি ফুটে উঠল।
“আই, আই, ক্যাপ্টেন। এরপর কী করতে হবে বলুন।”
“কাঠুরেদের বল পুড়ে যাওয়া কেবিনটা ঠিকঠাক করতে। এবার তাদেরকে বলবে যে তারা যেন সাদা রং করে। আমি আর জুডিথ আকাশী রং দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।”
ডেনি হাল-এর আদেশ অনুযায়ী কাজ করতে চলে গেল। এরপর হাল জুডিথ-এর দিকে ঘুরে দাঁড়াল, সেই সাথে তার হাত ধরে পুপ ডেক-এর ওপর নিয়ে এলো। এখন একমাত্র এই জায়গাটিতেই তারা একটু নীরবে সময় কাটাতে পারবে।
তারা দুজন রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়াল। জুডিথ হাল-এর কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলল না। অবশেষে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আস্তে ধীরে কথা বলতে শুরু করল জুডিথ।
“গ্রেইল রক্ষা পেয়েছে। আমার দায়িত্ব শেষ। আমি যুদ্ধ করতে করতে আর হত্যাযজ্ঞ দেখতে দেখতে ক্লান্ত। আমাদের জন্য কী এমন কোনো জায়গা খুঁজে নিতে পারবে না যেখানে তুমি, আমি আর আমাদের সন্তান বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারব?”
“তুমি এইমাত্র যে জায়গাটার কথা বললে, ওটার নাম হাই ওয়েল্ড,” হাল শব্দ করে হেসে বলল।
“হাই ওয়েল্ড? কী অদ্ভুত নাম রে বাবা! কী এটা? আর এটা আছেই বা কোথায়?”
“ইংল্যান্ডের দক্ষিণেই আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা বলতে পায়রা ওটাকে। আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি।”
“আমাকে এখুনি সেখানে নিয়ে চল! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব! আমি আর একমুহূর্তও এখানে থাকতে চাই নে!” “প্লিজ!” হাল-এর বাহুর মধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ওকে আরও শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল জুডিথ।