কিন্তু এই বাজপাখির ন্যায় লম্বা নাকওয়ালা মুখোশই তাকে এখন শক্তিশালী করে তুলেছে। এটা তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। এটা তার নষ্ট হয়ে যাওয়া মুখচ্ছবিকে ঢেকে রেখেছে এবং তাকে রহস্যময় এক নতুন সৃষ্টিতে পরিণত করেছে। এটাই তার শত্রুর মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। এই মুখোশই তাকে আরেকবার এর মতো শক্তিশালী যোদ্ধায় পরিণত করেছে।
সে তার ফাঁদ পেতে দিয়েছে এবং হাল কার্টনিও ভালভাবেই সেই ফাঁদে পা দিয়েছে।
কোকরান হয়ত তার একটি হাত, একটি চোখ এবং লিঙ্গের অধিকাংশ অংশ হারিয়ে ফেলেছে কিন্তু তার ব্রেইন এখনো কাজ করছে। তার ডান হাতের তলোয়ার এখনো মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করার জন্য যথেষ্ট।
গোল্ডেন বাউ-এলিফ্যান্ট লেগুন-এ পৌঁছার পর থেকেই মাদ্রি দি ডিয়াস যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল। এখন টপমাস্টম্যান তার স্টেশনে প্রস্তুত আছে, গানরা কামানে গুলি লোড় করে এর পেছনে অপেক্ষা করছে।
বুজার্ড-এর স্পাইরা তাকে খবর দিয়েছে যে তারা দুটো পানসিকে গোল্ডেন বাউ থেকে ছেড়ে যেতে দেখেছে। পানসি দুটো লেগুন-এর চূড়ার দিকে গিয়ে নদী পথের বাঁকের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে। টেলিস্কোপ দিয়ে তারা হাল কার্টনি আর অ্যাবোলিকে চিনতে পারল। কিন্তু ফেরার সময় আর তাদেরকে দেখতে পায়নি ওরা। হয়ত রাতের বেলা পাহারাদার ঘুমিয়ে পড়েছিল একারণে দেখতে পায়নি।
কিন্তু তাদেরকে না জানিয়েই ওরা এলিফ্যান্ট লেগুন ছেড়ে যেতে পারবেনা।
অপেক্ষা করতে করতে চতুর্থ দিন সূর্য উঠার পূর্বে বুজার্ড তার ফাঁদ গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে তার নাবিকদেরকে নিয়ে রণতরী সাজিয়ে ইন্ডিয়ান সাগরে এলিফ্যান্ট লেগুন-এর প্রবেশ পথ দিয়ে এগুতে থাকে। সে মাদ্রি দি ডিয়াস-এর সম্মুখভাবে টেলিস্কোপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকল। মুখোশ-এর ভেতর থেকে এক চোখের দৃষ্টি টেলিস্কোপ-এর ভেতরে নিবিষ্ট করে রাখল। সে দেখতে পেল, গোল্ডেন বাউ লেগুন-এর ভেতরের দিকে নোঙর করা আছে। এর গানপোর্টগুলো বন্ধ এবং মাস্তুলে কোনো পাল লাগানো নেই। জাহাজের ডেকটা খালি পড়ে আছে এবং মাস্তুলের চূড়ায় শুধু একজন পাহারাদারকে দেখা যাচ্ছে।
একটা পানসি তীরে ভেড়ানো আছে। নাবিকেরা নিশ্চয়ই খাবার পানি সংগ্রহ করছে। আরেকটা পানসিতে করে নাবিকেরা আগুন জ্বালানোর কাঠ সংগ্রহ করছে। কয়েকজন নাবিক তীরে আগুন জ্বালিয়ে বসে বসে নাস্তা খাচ্ছে।
সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে হাল লম্বা নদীপথ পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে নিশ্চয়ই কেপ অফ গুড হোপ-এর পাশ দিয়ে আটলান্টিক সাগর হয়ে ব্রিটিশ দ্বীপে যাবে। কিন্তু তার নাবিকেরা এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তাই তিন মাস্তুল বিশিষ্ট যুদ্ধ জাহাজ নীরবেই এলিফ্যান্ট লেগুন-এর প্রবেশ পথ দিয়ে এগুতে লাগল।
বুজার্ড ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন বারোস-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “ওদের উদ্দেশ্যে অন্তত একটা গুলির আওয়াজ করুন যেন বোকা বানরগুলো অন্তত সজাগ হতে পারে, প্লিজ, ক্যাপ্টেন।”
বাবোস তার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা গানার মাস্টার-এর উদ্দেশ্যে একটা হাততালি দিল। এরপর তীব্র কামানের শব্দ চারদিকে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল।
ব্রিটিশ নাবিকেরা হতবাক হয়ে মাদ্রি দি ডিয়াস-এর আগমন দেখতে থাকল।
“গোল্ডেন বাউ-এর দিকে জাহাজ চালনা কর, বুজার্ড তার পরবর্তী আদেশ দিল। ওটাকে এখন সহজেই আক্রমণ করা যাবে। কারণ ওর নাবিকেরা এখন দূরে দূরে রয়েছে।” সে তার গলা পরিষ্কার করে আরও পরিষ্কার কণ্ঠে বলতে থাকল, “আমি কার্টনিকে চাই। তোমরা কী শুনতে পেয়েছ? কার্টনি যদি জাহাজের ওপর না থাকে তবে আমি তার স্ত্রীকে চাই।”
জুডিথ নাজেত তার এবং হাল-এর কেবিনটাতে বসে বিশ্রাম করছিল। সে জানালার পাশে লেখার ডেস্কটাতে বসে ছিল। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেয়ে তাকিয়ে দেখল যে মসি তার কোঁকড়া চুল নাড়িয়ে কেবিন-এ প্রবেশ করছে।
“গুড মর্নিং, মাই কাইন্ড মিসট্রেস, আমি আপনার জন্য কফি নিয়ে এসেছি। চিনি এবং দুধ ছাড়া।”
“ধন্যবাদ”, মসি। কিন্তু “তুমি কীভাবে জান যে আমি এটা পছন্দ করি?”
“কারণ আপনি সবসময় এভাবেই কফি পান করেন।” সে চেহারায় একটা ঝকমকে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল। এটা তাদের নিত্য নৈমত্তিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মসি সবসময়ই চুপচাপ কেবিন-এ প্রবেশ করে কফি হাতে জুডিথ-এর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না জুডিথ টের পায়।
“আমি কী বাতিগুলো নিভিয়ে দেৰ, মাই লেডি?” সে হাত বাড়িয়ে মাথার উপরের বাতিগুলো নেভানোর জন্য উদ্যত হলো।
“না থাক, ধন্যবাদ মসি। এখনো বাইরে বেশ অন্ধকার। সূর্যের আলো পুরোপুরি উঠেনি।”
মসি মাথা নাড়াল এবং কপালের সামনের কেশগুচ্ছ সরাতে সরাতে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। জুডিথ নিজের মনে হেসে উঠল। সে ছেলেটিকে সত্যিই বেশ পছন্দ করতে শুরু করেছে। এরপর সে কলমের নিবটা কালির দোয়াতে ডুবিয়ে লিখতে শুরু করল, “ছোট্ট বর্বরটা আমার পেটে লাথি মারতে শুরু করেছে, সেই সাথে আমাকে সারা রাত জাগিয়ে রেখেছে ও। সে যখন বের হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে, কেবল তখনই আমি স্বস্তি পাব।”
কামানের গুলির শব্দটা এতটা কাছে হলো যে মনে হচ্ছে, সে যে কেবিনে বসে আছে সেটাতেই শব্দটা হয়েছে। সে এতটাই চমকে যায় যে হাত থেকে কলম পড়ে গিয়ে কাগজে কালি ছড়িয়ে পড়ে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে।