হাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার ভালবাসার মানুষটির ফিরে আসাটাকে একটা আনন্দপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় করে রাখতে হবে। গোল্ডেন বাউ-এর নাবিকেরা খুব শক্ত হাতে জাহাজটাকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে, প্রাণবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধের ময়দানে তার সহকর্মীদের মরে যেতে দেখেছে, সাগরে ভেসে যেতে দেখেছে। এখন তাদের আনন্দ করার সময়। পেটপুরে খাওয়া দাওয়া করার সময়। হাল তাদের আনন্দের মাত্রাটা এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করতে চায়। একারণে আজকের দিনটি সবার কাছেই আনন্দের দিন।
হাল সিদ্বান্ত নিয়েছে যখন সে বিয়ে করবে তখন কোনো ইংলিশ চার্চ-এ খ্রিস্টান পুরোহিতের দ্বারা বিয়ের কাজ সম্পন্ন করবে। যদিও এখনো জানে না সে কবে বিয়ে করবে। সে এবং জুডিথ সারাজীবন একসাথে কাটানোর ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। হাল এর পূর্বেও ভালবেসেছে। সে ভালবাসার তিক্ততা বা হারানোর ব্যথা জানে। কিন্তু জুডিথ-এর মতো স্থায়িত্ব বা নিশ্চয়তা এর পূর্বে সে কারও জন্য অনুভব করেনি। সে শুধুই তার। এই মেয়েটিই একদিন তার ভবিষ্যৎ সন্তানের মা হবে। এইটুকুই একজন পুরুষের জন্য অনেক কিছু।
উষালগ্নে হালকে দেখা গেল পুপ রেইল-এর ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে যেখান থেকে সে জাহাজের প্রতিটা মাস্তুল এবং প্রতিটা বেঞ্চ দেখতে পাচ্ছিল। ওখানে দাঁড়িয়ে সে পুরো জাহাজটিকে খুব সহজেই তার নির্দেশ অনুযায়ী চালাতে পারে। যদিও এখন পালগুলো গুটিয়ে রাখা হয়েছে, জাহাজটাও স্থির আছে। হাল একটু দূরে উপকূলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি দেখছে। তারা চামড়া ছাড়ানো মৃত ছাগল, গরুর মাংস আর মুরগি দিয়ে তাদের নৌকো বোঝাই করছে। সাথে আরও নানান ধরনের জিনিসপত্র তারা নৌকোয় তুলছে-ঝুড়ি ভর্তি সবজি, ফলমূল আর বড় বড় পোড়ামাটির পাত্র যেগুলো ভর্তি করা হয়েছে ওয়াট দিয়ে। ওয়াট হচ্ছে ইথিওপিয়ার জাতীয় খাবার। বিভিন্ন সবজি এবং মাংস সেদ্ধ করে এটা তৈরি করা হয়। ইনজেরা দ্বারা তৈরি পাউরুটি দিয়ে এটা পরিবেশন করা হয়। বস্তা ভর্তি কফির বীজ আর বাক্স ভর্তি রেড ওয়াইন-এর বোতলও নৌকোয় তুলছে তারা। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের চমৎকার সব ফুল এবং বাণ্ডিলও ওরা নৌকোয় তুলছে।
হাল বেশ কিছুক্ষণ ধরে দূরের এইসব হৈ হট্টগোল দেখল। যদিও তার বয়স মাত্র বিশ বছর কিন্তু পরিণত পুরুষের মতই ব্যক্তিত্ব বা বিচার বোধ সে এরই মধ্যে অর্জন করেছে। সমুদ্রযাত্রা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের কারণেই সে এসব অর্জন করতে পেরেছে। তাই তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সিরাও বিনা দ্বিধায় তার আদেশ পালন করতে বাধ্য হয়।
তার ধূসর দাগবিহীন ঘন কালো চুলগুলো-যেগুলো সে এখন মাথার পেছন দিকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে-একদম সেই আগের মতই আছে। ঠিক যেমনটা আছে সেই সবুজ রঙের চোখগুলো যেগুলো দেখে মহারাজা আইয়াসু বিস্ময়াবিভূত হয়েছিলেন। যদিও সবকিছু আগের মতো নেই; এই কয়েক বছর আগেও তার মধ্যে যে প্রায়-নারীসুলভ কোমল সৌন্দর্যটুকু ছিল, সেটার কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। তবে তার পিঠে এখনো রয়ে গিয়েছে কালো কালো দাগ, যেগুলো সে উপহার পেয়েছিল ডাচদের বন্দি হয়ে থাকার। ডাচদের কাছে বন্দি থাকাকালে দাসত্বের চেয়েও বেশি কষ্টকর ছিল তার জীবন। তার অভিজ্ঞতাগুলোই তাকে আরো কঠোর, আরো সহিষ্ণু বানিয়েছে যেটা তার ছায়া তার চোয়ালকে করে তুলেছে দৃঢ়, মুখের অভিব্যক্তিকে করেছে কঠোর, দৃষ্টিকে করেছে অন্তরভেদী।
জাহাজের পাশ কেটে যাওয়া জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে আপনমনেই বলে উঠল, “ইস! আজ যদি আমার বাবা-মা এখানে থাকতেন তাহলে তাদেরকে জুডিথকে দেখাতে পারতাম। যদিও আমি মায়ের চেহারা মনে করতে পারি নে। তিনি যখন মারা যান তখন আমি খুবই ছোট। কিন্তু আমার বাবা…” হাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। “আমার মনে হয়…তিনি বুঝতেন যে আমি সঠিক কাজটাই করছি…আশা করি…তিনি অন্তত আমাকে খারাপ ভাবতেন না।”
“অবশ্যই না,” পাশ থেকে একটা নতুন কণ্ঠ বলে উঠল। “সবসময়ই সে তোমাকে নিয়ে গর্বিত ছিল গান্ডওয়েন। শেষ সময়ে সে তোমাকে কী বলেছিলেন সেগুলো মনে করার চেষ্টা কর।”
হাল কথা বলতে পারছিল না। তার মনের চোখে শুধু ভেসে উঠছিল তার বাবার গলিত পচা লাশ কেপ কলোনীতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। স্যার ফ্রান্সিস কার্টনিকে জলপথে মিথ্যে ডাকাতির অভিযোগে ডাচরা এই শাস্তি দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল এইভাবে শাস্তি দিলে তারা গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবে, কিন্তু স্যার ফ্রান্সিস ভেঙে পড়েননি। তিনি তার শত্রুদের মনের আশা পূরণ হতে দেননি। একদিকে স্যার ফ্রান্সিস ফাঁসিতে ঝুলছিলেন, আর অন্যদিকে ছোট্ট হাল তা অসহায়ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।
“মনে আছে তোমার, সে শেষ মুহূর্তে কী বলেছিল?” ভদ্র কিন্তু জোরালো কণ্ঠটা আবারো বলে উঠল।
উত্তরটা দেয়ার আগে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হাল। “তিনি বলেছিলেন যে, আমি তারই রক্ত, তার স্বর্গীয় প্রতিজ্ঞা। এবং… এরপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “গুডবাই, মাই লাইফ।”
“আমার ধারণা, তুমি উত্তর পেয়ে গিয়েছ। তোমার বাবা তোমাকে দেখছেন। আমিই তাকে তার চিরবিদায়ের স্থানে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি দেখেছিলাম যে কিভাবে সে খোলা চোখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিল। তুমি যেখানেই থাক সে সবসময়ই তোমাকে দেখছে।”