শান্ত হয়ে এল তাইতা, মাথাটা একপাশে কাত করল, যেন সুমনার কথা শুনতে পাচ্ছে। ওর কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে এলেও তাতে তাগিদের ছাপ ফুটে উঠল। বিড়বিড় করে জবাব দিল তাইতা। ওকে নির্দেশনা দিচ্ছে সুমনা, বুঝতে পারল মেরেন। বিধ্বংসী ইমেজ ও শব্দ থেকে উদ্ধার পেতে অন্তর্চক্ষু বন্ধ করায় সাহায্য করছে। যেন কীসের অভিজ্ঞতা লাভ করছে বুঝতে পারে, ওকে আঘাত দিয়ে চলা আবেগের জোয়ারের উপর নিয়ন্ত্রণ খুঁজে পায়।
সেদিনের বাকি সময় ও পরবর্তী দীর্ঘ রাতের বেশির ভাগ সময় ওর পাশে রইল ওরা। ভোরের দিকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমে ঢলে পড়ল মেরেন। ওকে জাগানোর চেষ্টা করল না মেয়েরা। বিশ্রাম নিতে দিল। মারপিট আর কঠোর শারীরিক প্রয়াসে মজবুত ওর শরীর, কিন্তু ওদের আধ্যাত্মিক প্রাণশক্তির সাথে পেরে ওঠার মতো যোগ্যতা নেই। ওদের পাশে ও শিশুর মতো।
তাইতার খুব কাছে রইল সুমনা ও তানসিদ। এক সময় মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে, আবার একবার মনে হচ্ছে অস্থির, ঘোরের ভেতরে যাওয়া আসা করছে। চোখের পট্টির ওপাশে যেন কল্পনা থেকে বাস্তবতাকে আলাদা করতে পারছে না। একবার উঠে বসে ভীষণ শক্তিতে তানসিদকে বুকে টেনে নিয়েছিল ও। লস্ত্রিস! চিৎকার করে বলেছে। কথামতো ফিরে এসেছো তুমি। ওহ, আইসিস আর হোরাস। তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম আমি। এতগুলো বছর তোমার অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত হয়ে ছিলাম। আমাকে আর ছেড়ে যেয়ো না।
ওর এমনি বিস্ফোরণে কোনও রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি তানসিদ। ওর দীর্ঘ রূপালি চুলে বিলি কেটে দিয়েছে। তাইতা, নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। তোমার যতদিন প্রয়োজন, ততদিনই তোমার সাথে থাকব আমি। যতক্ষণ না ফের বোধহীনতায় ডুবে গেল ও, ততক্ষণ আলগোছে শিশুর মতো বুকের কাছে ধরে রাখল ওকে। তারপর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে সুমনার দিকে চোখ তুলে তাকাল ও। লস্ত্রিস!
এককালে মিশরের রানি ছিল, ব্যাখ্যা করল সুমনা। অন্তর্চক্ষু ও কশ্যপের প্রজ্ঞা দিয়ে তাইতার মনে গভীরে তদন্ত চালিয়ে ওর স্মৃতি খুঁড়ে বের করে আনছে। লস্ত্রিসের জন্যে ওর চিরস্থায়ী ভালোবাসা এতই স্পষ্ট যে, সুমনার কাছে ওর নিজের ভালোবাসা মনে হচ্ছে।
এতটুকু থেকে ওকে পেলেপুষে বড় করেছে তাইতা। সুন্দরী ছিল সে। ওদের আত্মা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও মিলিত হওয়ার জো ছিল না। বিক্ষত শরীরের কারণে পুরুষত্বহীনতার দরুণ ওর পক্ষে কোনওদিনই বন্ধু ও রক্ষাকারীর চেয়ে বেশি কিছু হওয়া সম্ভব ছিল না। তারপরেও সারা জীবন ওকে ভালোবেসেছেন উনি, মরণের পরেও থেমে নেই তা। মেয়েটাও বিনিময়ে ভালোবেসেছে ওকে। ওর কোলে মাথা রেখে মারা যাবার সময় লস্ত্রিস বলেছিল, এই জীবনে মাত্র দুজন পুরুষকে ভালোবেসেছি আমি, তুমি তাদের একজন। পরজন্মে দেবতারা হয়তো আমাদের ভালোবাসাকে আরও করুণার চোখে দেখবেন।
সুমনার কণ্ঠস্বর ভেঙে এল। দুটি মেয়ের চোখই অশ্রুতে টলমল করছে।
এর পর নেমে আসা নীরবতা ভঙ্গ করল তানসিদ। আমাকে সব খুলে বলল, সুমনা। সত্যিকারের ভালোবাসার চেয়ে সুন্দর কিছু পৃথিবীতে নেই।
লস্ত্রিস মারা যাবার পর, ম্যাগাসের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কোমল কণ্ঠে বলল সুমনা, ওকে আলিঙ্গন করেন তাইতা। ওকে সমাধিতে শোয়ানোর আগে মাথা থেকে এক গাছি চুল কেটে নিয়েছিলেন তিনি, সোনার লকেটে ভরে রাখেন। সামনে ঝুঁকে তাইতার গলায় সোনালী চেইনে ঝোলানো লস্ত্রিসের মাদুলি স্পর্শ করল ও। দেখেছো আজও ওটা পরে আছেন উনি। এখনও ওর ফেরার অপেক্ষা করছেন।
কেঁদে ফেলল তানসিদ। ওর দুঃখে সমব্যথী হলো সুমনা। কিন্তু চোখের পানিতে সেটা ধুয়ে ফেলতে পারল না। নিপূণ কারিগরের পথে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ায় এখন এই ধরনের স্বস্তিকর মানবীয় দুর্বলতা পেছনে ফেলে এসেছে। দুঃখ সুখেরই ভিন্ন চেহারা। শোকাকুল হওয়াই মানুষের চরিত্র। তানসিদের পক্ষে এখনও কান্নার অবকাশ আছে।
*
মহা বর্ষাকাল শেষ হওয়া নাগাদ বিপদ কাটিয়ে উঠল তাইতা, অন্তর্চক্ষু নিয়ন্ত্রণ শিখে গেল ও। ওর এই নতুন ক্ষমতা সম্পর্কে এখন সবাই সজাগ। এক ধরনের অলৌকিক স্থিরতার বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে ও। ওর কাছে থাকাটাকে স্বস্তিকর আবিষ্কার করেছে মেরেন ও তানসিদ, কথা না বললেও ওর সঙ্গে ভালো লাগছে।
অবশ্য, সজাগ থাকার বেশির ভাগ সময়ই সুমনার সাথে কাটাচ্ছে তাইতা। মন্দির দ্বারে দিনের পর দিন বসে থাকে ওরা, অন্তর্চক্ষু দিয়ে সামনে দিয়ে যারা যায় তাদের জরিপ করে। ওদের চোখে প্রতিটি মানবদেহ নিজস্ব আভায় জ্বলজ্বল করছে, বদলে যাওয়া আলোর মেঘ প্রত্যেকের আবেগ, ভাবনা ও চরিত্র মেলে ধরছে ওদের সামনে। এইসব সঙ্কেত ব্যাখ্যা করার কায়দা তাইতাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে সুমনা।
রাত নেমে এলে সবাই যার যার ঘরে চলে গেলে মন্দিরের অন্ধকার ঘরে দেবী সরস্বতীর প্রতিমার মাঝে ঘেরাও হয়ে বসে সুমনা ও তাইতা, সারা রাত কথা বলে পার করে, এখনও উচ্চ মর্যাদার দীক্ষাপ্রাপ্তদের প্রাচীন তেনমাস ভাষা ব্যবহার করছে ওরা, যার মাথামুণ্ড কিছুই বোঝে না মেরেন বা তানসিদ। যেন ওরা বুঝে গেছে বিদায়ের ক্ষণ শিগগিরই হাজির হবে ওদের সামনে। হাতের সময়টুকুর প্রতিটি সেকেন্ডের সদ্ব্যবহার করতে হবে ওদের।
তুমি কোনও আভা বিলোচ্ছ না? চূড়ান্ত আলোচনার সময় জানতে চাইল তাইতা।