কেঁপে উঠল তাইতা, মৃদু শ্বাস ফেলল। তারপর শূন্যতায় হারিয়ে যাওয়ায় শিথিল হয়ে এল তার শরীর। এমন কিছু হবে বলে মেরেনকে আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। শক্তিশালী হাতে তাইতার চিবুকটা উঁচু করে রাখল ও, যাতে ওর প্রিয় মানুষটির মাথা সামনে হেলে না পড়ে। যেমন সাবধানে ঢুকিয়েছিল ঠিক একই রকম সাবধানতায় চক্ষু কোটর থেকে উঁচটা বের করে আনল সুমনা। রক্তের লেশমাত্র নেই ওতে। ওর চোখের সামনে সূক্ষ্ম ক্ষতের মুখটা আপনাআপনি বুজে গেল।
গুনগুন করে অনুমোদনসুলভ একটা শব্দ করল সুমনা। এবার চামচ দিয়ে ঝুলন্ত চোখটা আবার আস্তে করে কোটরে বসাল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্রুত জায়গামতো বসার পর দ্রুত পিটপিট করতে লাগল তাইতার চোখের পাতা। লিনেনের ব্যান্ডেজের দিকে হাত বাড়াল সুমনা। আগেই নিরাময়কারী মলমে ভিজিয়ে মাৰ্বল টেবিলের উপর রেখেছিল তানসিদ। তাইতার মাথার চারপাশে পেঁচিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল।
যত তাড়াতাড়ি পারো, ওর জ্ঞান ফেরার আগেই ওকে ওর ঘরে নিয়ে যাও, মেরেন।
দুধের বাচ্চার মতো কোলে তুলে নিল ওকে মেরেন। সুঠাম কাঁধের উপর ওর মাথা রাখল। তাইতাকে নিয়ে দৌড়ে মন্দিরে ফিরে এল ও, তারপর ওকে ওর ঘরে নিয়ে এল। সুমনা ও তানসিদ অনুসরণ করল ওকে। মেয়ে দুটি পৌঁছানোর পর অগ্নিকুণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল তানসিদ। আগেই ওখানে একটা কেতলি চাপিয়ে রেখেছিল ও। এক বাটি ভেষজ নির্যাস ঢেলে নিল। সুমনার কাছে নিয়ে এল ওটা।
ওর মাথা তুলে ধরো! নির্দেশ দিল সুমনা। তাইতার ঠোঁটের কাছে ধরল বাটিটা, তরলটুকু আস্তে আস্তে ওর মুখে তুলে দিয়ে গলা ডলে দিতে লাগল যাতে গিলতে পারে। বাটির সবটুকু তরল খাওয়াল ওকে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আড়ষ্ট হয়ে গেল তাইতা, ওকে অন্ধ করে রাখা ব্যান্ডেজের দিকে হাত বাড়াল। যেন প্লাস্টার করা, এমনভাবে কাঁপতে শুরু করল ওর হাত। দাঁত কপাটি লেগে গেছে। তারপর দুপাটি এক করল ও। চোয়ালের গোড়ার পেশি শক্ত হয়ে উঠল। নিজের জিভ কামড়ে ছিঁড়ে ফেলতে পারে ভেবে ভয় পেল মেরেন। বুড়ো আঙুলে ম্যাগাসের দাঁত ফাঁক করার প্রয়াস পেল ও। কিন্তু আচমকা আপনাআপনি খুলে গেল তাইতার মুখ, আর্তনাদ করে উঠল ও। পাকা কাঠের মতো গিঁট পাকিয়ে গেল ওর শরীরে সমস্ত পেশি। একের পর এক খিঁচুনি কাঁপিয়ে দিল ওকে। সত্রাসে আর্তনাদ করে চলল ও, হতাশায় গোঙাল, তারপর যান্ত্রিক হাসিতে ফেটে পড়ল। ঠিক যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনি সহসা কাঁদতে শুরু করল, যেন ওর হৃদয় ভেঙে গেছে। তারপর ফের আর্তনাদ করে উঠল ও। পিঠ বেঁকে গেল, একেবারে গোড়ালি স্পর্শ করার যোগাড় হলো মাথার। এমনকি মেরেনও ওর দুর্বল নাজুক, প্রাচীন দেহটাকে সামলে রাখতে পারছে না, দানবীয় শক্তি ভর করেছে ওখানে।
ওর উপর কীসের আসর হলো? সুমনার উদ্দেশে মিনতিভরা কণ্ঠে জানতে চাইল মেরেন। নিজেকে শেষ করে ফেলার আগেই ওকে থামাও!
ওর অন্তর্চক্ষু এখন বিস্ফারিত। এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে শেখেনি। সাধারণ মানুষকে পাগল করে তোলার মতো এতই ভয়ঙ্কর সব ইমেজ বয়ে চলেছে ওর ভেতর, ওর মনকে ভরে দিচ্ছে। মানবজাতির সব ভোগান্তি সহ্য করছে ও। তাইতাকে তেতো ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সুমনাও এখন হাঁপাচ্ছে। সব ঘরের ছাদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে তাইতা।
এই উন্মাদনাই উত্তরের বোতাদকে মেরে ফেলেছিল, তানসিদকে বলল সুমনা। ইমেজগুলো ওর মগজকে ফুটন্ত তেল ভর্তি ব্লাডারের মতো ফুলিয়ে দিয়েছিল, এক সময় ধরে রাখতে না পারায় ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ব্যান্ডেজ খামচানো থেকে বিরত রাখতে তাইতার হাত ধরে রাখার চেষ্টা করছে ও। সব বিধবা আর সন্তানহারা মায়ের কষ্ট অনুভব করছে ম্যাগাস, যারা তাদের প্রথম সন্তানের মরণ প্রত্যক্ষ করেছে। রোগে শোকে কষ্ট পেয়ে প্রাণ হারানো প্রতিটি নারী পুরুষের ভোগান্তির স্বাদ পাচ্ছে। সমস্ত স্বৈরাচারীর নিষ্ঠুরতায়, মিথ্যার দৌরাত্মে অসুস্থ বোধ করছে। বিধ্বস্ত নগরীর আগুনে পুড়ছে, পরাস্তদের সাথে হাজার হাজার যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ হারাচ্ছে। জীবন্ত প্রতিটি জীবের প্রাণ হারানোর কষ্ট অনুভব করছে। নরকের গভীরে চোখ রাখছে।
এতে মারা যাবে ও! তাইতার মতোই সমান মাত্রার কষ্ট ভোগ করছে মেরেন।
যদি অন্তর্চক্ষু নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, হ্যাঁ, সত্যিই প্রাণ হারাতে পারে ও। ওকে ধরে রাখো। ওকে নিজের মতো চলতে দিয়ো না। ভীষণভাবে এপাশ-ওপাশ পাক খাচ্ছে তাইতার মাথা, বিছানার পাশের পাথুরে দেয়ালে টক্কর খাচ্ছে।
এবার উঁচু কাঁপা কণ্ঠে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করল সুমনা, ওর নিজের কণ্ঠস্বর নয় এটা। এই ভাষা এর আগে কখনও শোনেনি মেরেন। কিন্তু মন্ত্রে তেমন একটা কাজ হলো না।
নিজের বাহুতে তাইতার মাথা রাখল মেরেন। ওর দুপাশে অবস্থান নিলে সুমনা ও তানসিদ। নিজেদের দেহের সাহায্যে বাধা দিয়ে হিংস্র প্রয়াসে নিজেকে আহত করার হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ওর খোলা মুখে সুবাসিত ফুঁ দিচ্ছে তানসিদ। তাইতা! চিৎকার করে ডাকল ও। ফিরে এসো! আমাদের কাছে ফিরে এসো!
তোমার কথা শুনতে পাবে না ও, বলল সুমনা। সামনে ঝুঁকে দুই হাত বাটির মতো করে তাইতার ডান কানের কাছে, সত্যির কান, ধরল। মন্ত্রের মতো একই ভাষায় মৃদু কণ্ঠে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল। অর্থ না বুঝতে পারলেও প্রভাব টের পেল মেরেন। অপর ম্যাগাসের সাথে কথা বলার সময় তাইতাকে এই ভাষা ব্যবহার করতে শুনেছিল ও। ওদের গোপন ভাষা এটা, একে ওরা বলে তেনমাস।