সেদিনের বাকি সময়টুকু নীরব রইল ওরা। এদিকে পাথুরে টেবিলে নিজের কাজে ব্যস্ত রইল তানসিদ। অবশিষ্ট বাঁশের সুই পলিশ করে আর অস্ত্রপচারের সরঞ্জাম সাজিয়ে সময় কাটাল সে।
অবশেষে তাইতার দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে কথা বলল সুমনা। এখন আপনি জানেন কোন ঝুঁকির ভেতর পড়তে যাচ্ছেন। চেষ্টা করতে বাধ্য নন আপনি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সম্পূর্ণ আপনার।
মাথা নাড়ল তাইতা। আমার কোনও উপায় নেই। এখন আমি জানি, আমার জন্মক্ষণেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে।
*
সেই রাতে তাইতার ঘরে ঘুমাল তানসিদ ও মেরেন। বাতি নেভানোর আগে তোইতাকে একটা চীনা মাটির গামলা ভর্তি গরম ভেষজ নির্যাস দিল তাসনিদ। ওটা খাওয়ার প্রায় সাথে সাথে তক্তপোষের উপর লুটিয়ে পড়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল তাইতা। ওর শ্বাস প্রশ্বাস পরখ করে দেখতে আর ভোরের শীতল হাওয়া ঘরে ঢুকতে শুরু করলে ওর গায়ে চাদর টেনে দিতে রাতে দুবার জেগে উঠল মেরেন।
ঘুম থেকে জেগে ওদের তিনজনকে দেখতে পেল তাইতা: সুমনা, তানসিদ ও মেরেন। ওর তক্তপোষ ঘিরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।
ম্যাগাস, আপনি তৈরি? সতর্ক কণ্ঠে জানতে চাইল সুমনা।
মাথা দোলাল তাইতা, কিন্তু মেরেন হড়বড়িয়ে কথা বলে উঠল, এই কাজ করতে যাবেন না, ম্যাগাস। নিজের উপর একাজ করতে যাবেন না, এটা অশুভ।
ওর পেশল বাহু হাতে তুলে নিয়ে শক্ত করে দোলাল তাইতা। ঝুঁকির কথা ভেবেই তোমাকে বেছে নিয়েছি। তোমাকে আমার দরকার। আমাকে হতাশ করো, মেরেন। কাজটা একা করতে হলে পরিণতি কী হবে কে বলতে পারে? একসাথে আমরা বিজয়ী হতে পারব, আগেও যেমন অনেকবার জিতেছি। বেশ কয়েকবার অনিয়মিত শ্বাস টানল মেরেন। তুমি তৈরি, মেরেন? বরাবরের মতো আমার পাশে থাকছ?
আমাকে ক্ষমা করবেন, দুর্বলতায় আক্রান্ত হয়েছিলাম আমি, তবে এখন আমি তৈরি, ম্যাগাস, ফিসফিস করে বলল ও।
উদ্যানের উজ্জ্বল রোদের আলোয় নিয়ে এলো ওদের সুমনা, সেখান থেকে প্রাচীন দালানে। মাৰ্বল টেবিলের এক কিনারে শৈল্য চিকিৎসকের সরঞ্জাম রাখা। অন্যপ্রান্তে একটা কয়লার ভাণ্ড রয়েছে; ওটার উপর তপ্ত হাওয়া কাঁপছে। নিচের মেঝেয় ভেড়ার পশমের গালিচা বিছানো। তাইতাকে কিছু বলার দরকার হলো না, টেবিলের দিকে মুখ করে গালিচার উপর হাঁটু গেড়ে বসল ও। মেরেনের উদ্দেশে মাথা দোলাল সুমনা, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে আগেই ওকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে ও। তাইতার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ও। তারপর এমনভাবে দুহাতে আলিঙ্গন করল ওকে যাতে তাইতা নড়াচড়া করতে না পারে।
চোখ বন্ধ করো, মেরেন, নির্দেশ দিল সুমনা। দেখতে যেয়ো না। ওদের সামনে এসে দাঁড়াল সুমনা, তারপর একটা চামড়ার ফিতে বাড়িয়ে দিল তাইতাকে দাঁতে চেপে রাখতে। মাথা নেড়ে প্রত্যাখ্যান করল তাইতা। ডান হাতে একটা রূপার চামচ নিয়ে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসল ও, তারপর অন্য হাতের দুই আঙুলে তাইতার ডান চোখের পাতা ফাঁক করল। সব সময়ই ডান চোখে দিতে হয়, ফিসফিস করে বলল ও। সত্যির দিক। চোখের পাতা বড় করে টেনে রাখল ও। শক্ত করে ধরে রাখ, মেরেন!
ঘোঁৎ করে সায় দিল মেরেন, আরও শক্ত করে চেপে ধরল তাইতাকে। এক সময় গুরুর চারপাশে ব্রোঞ্জের রিংয়ের মতো হয়ে উঠল ওর হাতের বাঁধন। চামচের প্রান্তটা দৃঢ়, নিশ্চিত হাতে তাইতার চোখের উপরের পাতার নিচে পিছলে ঢুকিয়ে দিল সুমনা, আস্তে অক্ষিগোলকের পেছনে নিয়ে গেল। তারপর আস্তে করে কোটর থেকে চোখটা বের করে আনল। তাইতার গালের উপর ডিমের মতো ঝুলে থাকতে দিল ওটাকে। অপটিক নার্ভের ফিতের সাথে ঝুলছে। শূন্য কোটরটা যেন গোলাপি গভীর গুহা, চোখের জলে চকচক করছে। রূপার চামচটা তানসিদের হাতে তুলে দিল সুমনা। ওটাকে একপাশে নামিয়ে রেখে একটা বাঁশের সূঁচ তুলে নিল তানসিদ। ডগাটাকে কয়লার আগুনের উপর ধরে রাখল ও, যতক্ষণ না সেটা পুড়ে শক্ত হয়ে গেল। ধোঁয়া ওঠা সঁচটা এবার সুমনার হাতে তুলে দিল ও। ডান হাতে সঁচটা নিয়ে তাইতার শূন্য কোটর বরাবর চোখ না আসা পর্যন্ত মাথা নামিয়ে আনল সুমনা। অপটিক পাথওয়ের করোটিতে ঢোকার পথের কোণ আর অবস্থান যাচাই করল।
ওর আঙুলের নিচে তাইতার চোখের পাতা নড়ছে, কাঁপছে, নিয়ন্ত্রণের অতীত পিটপিট করে চলেছে। গ্রাহ্য করল না সুমনা। আস্তে আস্তে সুইটা চক্ষু কোটরে ঢুকিয়ে দিল, যতক্ষণ না সেটা পাথওয়ের প্রবেশ মুখ স্পর্শ করল। চাপ বাড়াল ও, যতক্ষণ না আকস্মিকভাবে সুইটা পর্দা ভেদ করে স্নায়ুর কোনও ক্ষতি না করেই নার্ভের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে গেল। যাবার পথে বলতে গেলে কোনও বাধার মুখে পড়ল না। ক্রমে গভীরে প্রবেশ করল ওটা। মগজের ফ্রন্টাল লোবের প্রায় এক আঙুল সমান গভীরতায় ঢোকার পর ঠিক অনুভব করা নয়, সূঁচটা দুচোখের ভেতর থেকে বের আসা স্নায়ু তন্তুর বান্ডিল যেখানে অক্ষিকোটরের অপটিক খাদ পেরিয়েছে সেখানে কিঞ্চিত বাধা টের পেল সুমনা। বাঁশের ডগাটা পোর্টালে পৌঁছেছে। ওর অভিব্যক্তি শান্ত থাকলেও সুমনার নির্মল ত্বকের উপর ক্ষীণ স্বেদবিন্দুর আস্তরণ দেখা দিয়েছে। চোখজোড়া সরু হয়ে গেছে। টানটান হয়ে গেছে ও, শেষ ধাক্কাটা দিল এবার। তাইতার দিক থেকে কোনও রকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সুমনা বুঝতে পারল সূক্ষ্ম লক্ষ্যভেদ করতে পারেনিও। সামান্য পিছিয়ে আনল সুইটা, তারপর সেই আগের গভীরতায় ফের ঠেলা দিল। এইবার একটু উপরে।