দিনের বাকি সময় আর পরবর্তী রাতের অর্ধেকটা একসাথে ওদের ভেতর এপর্যন্ত যা কিছু বিনিময় হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করল ওরা। তারপর ওকে নিজের শোবার ঘরে নিয়ে এলো সুমনা, ভোরের আলো চেম্বার ভরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত মা আর শিশুর মতো পরস্পর গায়ে গা লাগিয়ে ঘুমাল। ঘুম থেকে উঠে এক সাথে স্নান করল ওরা। তারপর ওকে উদ্যানের এক গোপন কোণের প্রাচীন পাথুরে দালানে নিয়ে এলো সুমনা। এখানে আগে আসেনি তাইতা। আগেই এসেছে তানসিদ। বিশাল মূল কামরার মাঝখানে রাখা একটা মাৰ্বল পাথরের টেবিলে কাজে ব্যস্ত। ওরা ঢুকতেই চোখ তুলে তাকাল। বাকি সুইগুলো তৈরি করছি, ব্যাখ্যা করল সে। তবে তোমরা একা থাকতে চাইলে আমি চলে যাব।
না, তুমি থাকো, প্রিয় তানসিদ, বলল সুমনা। তোমার উপস্থিতি আমাদের কোনও সমস্যা করবে না। তাইতার হাত ধরে গোটা কামরায় ঘুরে বেড়াল ও। গোড়াতে প্রথম দিকের যাজকরা এই কামরার নকশা করেছিলেন। কাজ করার জন্যে স্পষ্ট আলোর প্রয়োজন ছিল তাদের। মাথার উপর অনেক উঁচুতে বসানো বিরাট আকারের খোলা জানালাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল ও। এই অপারেশন টেবিলের উপর পঞ্চাশ প্রজন্মেরও বেশি যাজক অন্তর্চক্ষু খোলার অস্ত্রপচার করেছেন। রা প্রত্যেকেই ছিলেন জ্ঞানী, কথাটা দিয়ে আমরা গুরুকে বোঝাই, যারা অন্য মানুষ ও জীব জানোয়ারের আভা দেখতে পান। দেয়ালের খোদাই করা লেখাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল ও। আমাদের আগে শতাব্দীর পর শতাব্দী, সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ যারা বিদায় নিয়েছেন, তাদের সবার কথা রয়েছে ওখানে। আমাদের ভেতর কোনও বাধা থাকতে পারবে না। আপনাকে মিথ্যা আশ্বাসও দেব না–কথা বলার আগেই যেকোনও রকম প্রতারণার প্রয়াস স্পষ্ট বুঝে যাবেন আপনি। তো আপনাকে সত্যি করে বলছি, সফল হওয়ার আগে কশ্যপের অভিভাবকত্বে চারবার অন্তর্চক্ষু খোলার চেষ্টা করেছিলাম আমি।
সবচেয়ে সাম্প্রতিক খোদাই লিপির দিকে ইঙ্গিত করল ও। এখানে আমার প্রয়াসের নথি দেখতে পাচ্ছেন। প্রথমে হয়তো আমার দক্ষতা আর নৈপূণ্য ছিল না। আমার রোগিরা হয়তো ডান দিকের পথে যথেষ্ট অগ্রগামী ছিল না। একবার তো ফল ছিল মহাবিপর্যয়কর। আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, তাইতা, এটা বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এক মুহূর্ত নীরব রইল সুমনা, ভাবছে। তারপর ফের খেই ধরল। আমার আগেও অনেকে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে দেখুন! দেয়ালের আরও দূরবর্তী প্রান্তের শেওলায় ঢাকা সুপ্রাচীন খোদাই লিপির কাছে নিয়ে গেল ওকে সুমনা। এগুলো এত পুরোনো হয়ে গেছে যে পাঠোদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তবে ওখানে কী লেখা আছে বলছি। প্রায় দুই হাজার বছর আগে এক মহিলা এসেছিলেন এই মন্দিরে। এককালে এজিয়ান সাগরের তীরে লিয়ন নামে এক শহরের এক প্রাচীন জাতির জীবিত সদস্য ছিল সে। অ্যাপোলোর প্রধান পুরোহিতিনী। আপনার মতোই দীর্ঘায়ু। তার সাম্রাজ্যের পতন ও ধ্বংসের পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পৃথিবীময় ঘুরে জ্ঞান আর বিদ্যা আয়ত্ত করেছে। তখন এখানকার যাজক ছিলেন কর্মা। অচেনা মহিলা নিজেকে সত্যির প্রতিমূর্তি হিসাবে তুলে ধরতে পেরেছিল তার সামনে। এভাবে তার অন্তর্চক্ষু খোলাতে রাজি করাণ তাকে। এটা এমন এক সাফল্য ছিল যার ফলে যাজক বিস্মিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কিন্তু মহিলা মন্দির ছেড়ে চলে যাবার বেশ পরেই সন্দেহ আর কুচিন্তায় ভরে ওঠে কমার মন। কয়েকটা মারাত্মক ঘটনার ফলে তিনি বুঝতে পারেন মহিলা সম্ভবত প্রতারক, চোর, বামপন্থার গুরু, মিথ্যার দাস হবে। অবশেষে তিনি জানতে পারেন, প্রকৃতপক্ষে যাকে বাছাই করা হয়েছিল তাকে হত্যা করার জন্যে ডাকিনীবিদ্যা কাজে লাগিয়েছে সে। নিহত নারীর পরিচয় ধারণ করে তাকে ভাওতা দিতে আপন পরিচয় যতটুকু সম্ভব আড়াল করতে পেরেছিল সে।
কী পরিণতি হয়েছে চিড়িয়াটার?
সরস্বতী দেবীর যাজকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাকে খুঁজে বের করা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিজেকে আড়াল করে উধাও হয়ে গেছে সে। এতদিনে হয়তো মরে গেছে। সবচেয়ে ভালো এটাই আশা করতে পারি আমরা।
কী নাম তার? জিজ্ঞেস করল তাইতা।
এই যে! এখানে খোদাই করা আছে। আঙুলের ডগা দিয়ে লেখা স্পর্শ করল সুমনা। নিজেকে সূর্যদেবতার বোনের নামে, ইয়োস পরিচয় দিয়েছিল সে। এখন আমি জানি, এটা তার আসল নাম না। তবে তার আত্মার চিহ্ন ছিল বেড়ালের থাবার ছাপ। এই যে এখানে।
আরও কতজন ব্যর্থ হয়েছে? বিষণ্ণ ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল তাইতা।
অনেক।
তোমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটা বলো।
এক মুহূর্ত ভাবল সুমনা, তারপর বলল, আমি যখন একেবারে নবীশ ছিলাম তখনকার একটা ঘটনার কথা বিশেষভাবে মনে আছে। তার নাম ছিল বোতাদ, দেবতা ভোদেনের যাজক ছিলেন তিনি। পবিত্র নীল টাটুতে ভরা ছিল তাঁর শরীর। শীতল সাগরের ওপারের উত্তরের দেশ থেকে আনা হয়েছিল তাঁকে। বিশাল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। কিন্তু বাঁশের সুইয়ের নিচে মারা গেছেন। অন্তরের মুক্ত শক্তির কাছে টিকে থাকার পক্ষে তার মহাশক্তি যথেষ্ট ছিল না। মগজ ফেটে গিয়েছিল, নাক কান থেকে রক্ত বের হয়ে এসেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুমনা। ভয়ঙ্কর কিন্তু দ্রুত ছিল মরণটা। হয়তো বোদ ওর আগে যারা এই কাজে যোগ দিয়েছিলেন তাদের চেয়ে ভাগ্যবান ছিলেন। অন্তর্চক্ষু মালিকের উপরই বিগড়ে যেতে পারে, লেজ ধরে রাখা বিষাক্ত সাপের মতো। এতে ফুটে ওঠা কিছু আতঙ্ক এতই স্পষ্ট ও ভয়ঙ্কর যে, বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।