একটু ভাবল তাইতা। তারপর জবাব দিল আমার বিশ্বাস বিশ্বজগৎ দুটো শক্তিশালী বাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্র। তার প্রথমটি সত্যির দেবতাদের বাহিনী, দ্বিতীয়টি মিথ্যার দানোদের।
এই ভীষণ সংগ্রামে আমাদের মতো মরণশীলরা কী করতে পারে? জিজ্ঞেস করল সুমনা।
আমরা সত্যির প্রতি নিজেদের নিবেদন করতে পারি, কিংবা মিথ্যার কাছে গ্রস্ত হতে দিতে পারি।
সত্যির ডান দিকের পথ বেছে নিলে কীভাবে মিথ্যার অন্ধকার শক্তির মোকাবিলা করতে পারব?
চিরন্তন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যতক্ষণ না সত্যির রূপ স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। সেটা অর্জন করার পর আমরা দয়াময় অমরদের দলে যোগ দিতে পারব। এরাই সত্যির যোদ্ধা।
এটাই কি সব পুরুষের নিয়তি?
নাহ! অল্প কয়েকজনের, কেবল সুযোগ্যরাই এই মর্যাদা লাভ করবে।
সময়ের শেষে সত্যি কি মিথ্যার বিরুদ্ধে জয়ী হবে?
নাহ! মিথ্যা টিকে থাকবে, তবে সত্যিও। এই যুদ্ধ অন্তহীনভাবে সামনে পেছনে চলতে থাকে।
সত্যি কি ঈশ্বর নন?
তাকে রা বা আহুরা মাযদা, বিষ্ণু বা যিউস, ওদেন বা তোমার কানে মধুর যেকোনও নামে ডাকতে পারো। কিন্তু ঈশ্বর ঈশ্বরই, এক এবং অদ্বিতীয়। আপন বিশ্বাসের স্বীকারোক্তি দিল তাইতা।
আপনার আভা থেকে দেখতে পাচ্ছি আপনার এই নিশ্চয়তায় মিথ্যার লেশ নেই, শান্ত কণ্ঠে বলল সুমনা, হাঁটু গেড়ে বসল ওর সামনে। আমার ভেতরে অবস্থানরত কশ্যপের আত্মা আপনি সত্যিই সত্যির পক্ষে থাকায় সন্তুষ্ট। আমাদের উদ্যোগে কোনও বাধা বা কুণ্ঠা নেই। এবার আমরা কাজে নামতে পারি।
তার আগে আমাদের উদ্যোগটা একটু বুঝিয়ে দাও, সুমনা।
এই কঠিন সময়ে মিথ্যা আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। নতুন ভয়ঙ্কর এক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে গোটা মানবজাতিকে, বিশেষ করে আপনার প্রিয় মিশরকে। এই ভীষণ বস্তুর বিরুদ্ধে তৈরি করার জন্যেই এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছিল আপনাকে। আমি আপনার অন্তর্চক্ষু খুলে দেব, তাহলে কোন পথ ধরে চলতে হবে সেটা স্পষ্ট দেখতে পাবেন। উঠে ওকে আলিঙ্গন করল সুমনা। তারপর আবার কথা বলল সে। এখন হাতে বেশি সময় নেই। সকালে শুরু করব আমরা। তার আগে অবশ্য একজন সাহায্যকারী বেছে নিতে হবে।
সেটা কাদের ভেতর থেকে? জানতে চাইল তাইতা।
আপনার অপ্সরা তানসিদ আগেও আমাকে সাহায্য করেছে। কী করতে হবে ও জানে।
তবে ওকেই বেছে নাও. রাজি হলো তাইতা। মাথা দুলিয়ে তানসিদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সুমনা। তারপর আবার তাইতার দিকে তাকাল।
আপনাকেও সাহায্যকারী বেছে নিতে হবে, বলল সুমনা।
তাকে কী করতে হবে সেটা বলো।
তাকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে, আপনার জন্যে দরদ থাকতে হবে। তার প্রতি আপনার অগাধ আস্থা থাকতে হবে।
একটুও দ্বিধা করল না তাইতা। মেরেন!
নিশ্চয়ই, সায় দিল সুমনা।
*
ভোরে পর্বতমালার পাদদেশ ধরে উঠতে শুরু করল ওরা চারজন। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথ ধরে ঢাল বেয়ে উপরের বাঁশ বনে পৌঁছাল। একটা পাকা ডাল বেছে নেওয়ার আগে দোল খেতে থাকা অনেকগুলো হলদে বাঁশ পরখ করল সুমনা। তারপর মেরেনকে দিয়ে বড়সড় একটা টুকরো কাটাল। ওটা সহ মন্দিরে ফিরে এল ও।
বাঁশের ডাল থেকে বেশ কয়েকটা লম্বা কাঠি বানাল সুমনা ও তানসিদ। পলিশ করতে করতে এক সময় মানুষের চুলের মতো সরু অথচ সূক্ষ্মতম ব্রোঞ্জের চেয়েও তীক্ষ্ণ ও ঘাতসহ হয়ে গেল ওগুলো।
মন্দির সমাজের প্রশান্তিতেও এক ধরনের উত্তেজনা আর প্রত্যাশার আবহ টের পাওয়া যাচ্ছে। অপ্সরাদের উঁচু গলার হাসি ও প্রাণবন্ত ভাব চাপা পড়েছে। যখন তাইতার দিকে তাকাচ্ছে তানসিদ, ওর চোখে যুগপৎ বিস্ময় ও করুণার ছাপ পড়ছে। অপেক্ষার বেশির ভাগ দিনগুলো পাশে থেকে বিপদের জন্যে শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করছে সুমনা। অনেক বিষয় নিয়েই আলাপ করছে ওরা। কশ্যপের প্রজ্ঞা ও কণ্ঠে কথা বলেছে সুমনা।
এক পর্যায়ে ওকে দীর্ঘ সময় ধরে খুঁচিয়ে চলা একটা প্রসঙ্গের অবতারণা করল তাইতা: আমার বিশ্বাস তুমি একজন দীর্ঘায়ু, সুমনা।
আপনারই মতো, তাইতা।
এটা কীভাবে সম্ভব যে আমরা অল্পকিছু বাকিদের চেয়ে অনেক বেশিদিন বেঁচে থাকি? জিজ্ঞেস করল ও। এটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ।
আমার আর যাজক কশ্যপের মতো যারা তাদের ক্ষেত্রে এর কারণ সম্ভবত আমাদের জীবনযাত্রার কায়দা: আমাদের খাবার, পানীয়, আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসের ব্যাপার। কিংবা হয়তো, আমাদের একটা লক্ষ্য আছে বলে, চালিয়ে যাওয়ার একটা উদ্দেশ্য, ক্রমাগত খুঁচিয়ে চলা একটা পির।
আমার বেলায়? তোমার আর যাজকের তুলনায় নিজেকে কিশোর মনে হলেও সাধারণ লোকের মেয়াদ অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি, বলল তাইতা।
হাসল সুমনা। আপনার মনটা ভালো। এ পর্যন্ত আপনার বুদ্ধির শক্তি আপনার দৈহিক দুর্বলতাকে পরাস্ত করতে পেরেছে, কিন্তু শেষ বিচারে কশ্যপের মতো আমাদের সবারই মরতে হবে।
আমার প্রথম প্রশ্নের জবাব দিয়েছো তুমি, কিন্তু আরেকটা প্রশ্ন আছে। কে আমাকে বেছে নিয়েছে? জানতে চাইল তাইতা, যদিও জানত এই প্রশ্নের জবাব মিলবে না।
মিষ্টি হেঁয়ালিময় হাসি দিয়ে সামনে ঝুঁকে ওর ঠোঁটে উপর একটা আঙুল রাখল সুমনা। আপনাকে বাছাই করা হয়েছে, বলল ফিসফিস করে, এতেই সম্ভষ্ট থাকুন। তাইতা জানে ওকে জ্ঞানের শেষ সীমায় ঠেলে দিয়েছে ওঃ এরপর তার পক্ষে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।