আমি যা বুঝতে পারছি, মিনতাকাকে দাঁড় করালেন ফারাও। তোমার জন্যে শাস্তি হচ্ছে আমার সাম্রাজ্য থেকে সোয়ে ও জাদুকরীর শেষ চিহ্ন মুছে যাওয়ার আগুনের মশালটা তুমিই জ্বালবে।
দুলতে শুরু করলেন মিনতাকা, চরম হতাশা ভর করল তার চেহারায়, তারপর যেন নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। আমি ফারাওর বিশ্বস্ত স্ত্রী ও প্রজা। তাঁর নির্দেশ মানাই আমার কর্তব্য। আমি সোয়ের পায়ের নিচে আগুন ধরাব, একদিন যাকে বিশ্বাস করেছিলাম।
লর্ড মেরেন, এই জঘন্য প্রাণীটাকে প্রাঙ্গণে নিয়ে যাও, ওখানে শূল রাখা আছে। রানি মিনতাকা তোমার সাথে যাবেন।
সেনাদল সোয়েকে মাৰ্বল সিঁড়ি বেয়ে প্রাঙ্গণে নিয়ে গেল। ওদের অনুসরণ করল মেরেন। ওর বাহুতে নিজেকে এলিয়ে দিয়েছেন মিনতাকা।
আমার পাশে দাঁড়াও, ম্যাগাস, তাইতাকে নির্দেশ দিলেন ফারাও। আমাদের শত্রুর পরিণতির সাক্ষী থাকবে তুমি। এক সাথে প্রাঙ্গণে খোলা বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন তারা।
ওদের নিচের প্রাঙ্গণের মাঝখানে গাছের গুঁড়ি আর প্যাপিরাসের বান্ডিল দিয়ে তৈরি একটা তূপ দাঁড়িয়ে আছে। কুপির তেলে ভেজানো হয়েছে ওটাকে। চিতার উপরে বানানো মাঁচার দিকে চলে গেছে একটা কাঠের মই। পায়ের কাছে অপেক্ষা করছে দুজন তাগড়া চেহারার জল্লাদ। সোয়েকে প্রহরীদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে টেনে নিয়ে চলল ওরা। পা জোড়া কোনওমতে ধরে রেখেছে তাকে। শূলের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হলো তাকে। মই বেয়ে নেমে এলো ওরা। চূড়ায় রয়ে গেল সে। প্রাঙ্গণের দরজার কাছে রাখা জ্বলন্ত পাত্রের দিকে এগিয়ে গেল মেরেন। অগ্নিশিখায় আলকাতরায় ভেজানো মশাল ডোবাল ও। মিনতাকার কাছে এনে তার হাতে তুলে দিল। মৃত্যুদণ্ডের চিতার পায়ের কাছে মিনতাকাকে রেখে সরে এলো ও।
মাথার উপরে বারান্দায় দাঁড়ানো ফারাওর দিকে তাকালেন মিনতাকা। করুণ ওর অভিব্যক্তি। ওর দিকে তাকিয়ে মাথা দোলালেন ফারাও। এক মুহূর্ত বেশি ইতস্তত করলেন মিনতাকা। তারপর তেলে ভেজানো প্যাপিরাসের তূপে ঠেসে দিলেন জ্বলন্ত মশাল। চিতার পাশ ঘেঁষে একটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছুটে আসতেই টলমল পায়ে সরে এলেন তিনি। আগুনের শিখা আর ধোয়া প্রাসাদের ছাদ ছাড়িয়ে গেল। অগ্নিশিখার মাঝখানে মেঘহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে আর্তচিৎকার করল সোয়ে। আমার কথা শুনুন, ইয়োস, একমাত্র দেবী! আপনার অনুগত ভৃত্য আপনাকে আহ্বান করছে। আমাকে অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার করুন। এই খুচরো ফারাও আর সারা বিশ্বকে আপনার ক্ষমতা আর পবিত্র শক্তি দেখান! তারপর আগুনের লেলিহান শিখার করকর আওয়াজে চাপা পড়ে গেল তার কণ্ঠস্বর। ধোঁয়া ও তাপ গিলে নেওয়ায় শক্ত বাঁধনের উপর হেলে পড়ল সোয়ে। দাউদাউ শিখা ঢেকে ফেলল তাকে। মুহূর্তের জন্যে ফাঁক হয়ে কালো, বিকৃত অবয়বটা মেলে ধরল, এখন আর মানুষ বলে চেনার উপায় নেই, এখনও শূলে ঝুলে আছে। তারপর চিতাটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। আগুনের কেন্দ্রে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সে।
মিনতাকাকে টেনে সিঁড়ি ঘরের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে এলো মেরেন, তারপর পথ দেখিয়ে রাজকীয় দরবার হলে নিয়ে এলো। বয়স্কা, নাজুক নারীতে পরিণত হয়েছেন তিনি, সৌন্দর্য ও মর্যাদা তিরোহিত হয়েছে। ফারাওর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসলেন তিনি। হে প্রভু, আমার স্বামী, আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, ফিসফিস করে বললেন। আমি নির্বোধ নারী, যা করেছি তার কোনও অজুহাত হয় না।
তোমাকে ক্ষমা করা হলো, বললেন নেফার সেতি, তারপর যেন এরপর কী করতে হবে বুঝতে পারলেন না। রানিকে দাঁড় করানোর একটা ভঙ্গি করলেন, কিন্তু পরক্ষণেই পিছিয়ে গেলেন। তিনি জানেন এ ধরনের ঔদ্ধত্য স্বর্গীয় ফারাওর পক্ষে বেমানান। তাইতার দিকে চোখ ফেরালেন তিনি। তার পরামর্শ চাইছেন। ফেনের বাহু স্পর্শ করল তাইতা। মাথা দুলিয়ে পর্দা তুলল ও। সোনালি সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়ে পড়ল তার। এগিয়ে এসে মিনতাকার সামনে দাঁড়াল। আসুন, আমার রানি, বলল ও, মিনতাকার হাত ধরল।
মুখ তুলে ওর দিকে তাকালেন রানি। কে তুমি? কম্পিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন।
আমি সে যে আপনার জন্যে অনেক ভাবে, জবাব দিল ফেন। তুলে নিল ওকে।
ওর সবুজ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন মিনতাকা। সহসা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। আমার মনে হচ্ছে বয়সের তুলনায় তুমি অনেক ভালো আর প্রাজ্ঞ, বলে ফেনের আলিঙ্গনে ধরা দিলেন তিনি। ওকে নিবিড় করে ধরে রেখে ঘরে নিয়ে গেল তাকে ফেন।
ওই মেয়েটা কে? তাইতাকে জিজ্ঞেস করলেন নেফার সেতি। জানার জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আমাকে বলো, ম্যাগাস। এটা রাজকীয় আদেশ।
ফারাও, সে আপনার দাদীমার অবতার, রানি লস্ত্রিস, জবাব দিল তাইতা। যাকে একবার আমি ভালোবেসেছিলাম, এখন আবার ভালোবাসছি।
মেরেনের নতুন ভূসম্পত্তির সীমানা নীল মাতার তীর বরাবর তিরিশ লীগ পর্যন্ত বিস্তৃত। ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে অন্যতম রাজকীয় প্রাসাদ আর বাজপাখি দেবতা হোরাসের প্রতি নিবেদিত একটা অসাধারণ সৌন্দর্য মণ্ডিত মন্দির। তিন হাজার বর্গা চাষী উর্বর জমিন চাষ করে, নদীর জলে সেঁচ করা হয় এসব জমিন। নতুন ভূস্বামী লর্ড মার্শাল মেরেনকে ফসলের এক পঞ্চমাংশ কর দেয় ওরা। দেড়শো দাস শ্রমিক আর দুই শো ফারাওর যুদ্ধ বন্দি প্রাসাদ বা সম্পত্তির নিজস্ব জমিদারিতে কাজ করে।