রানির চেয়ে উঁচু সিংহাসনে বসে আছেন ফারাও। বুকের কাছে বিচার ও সাজার প্রতীক সোনালি ফ্লেইল ক্রস করে রাখা। তাঁর মাথায় লম্বা লাল-শাদা দুই রাজ্যের মুকুট, শক্তিমান একজন হিসাবে পরিচিত শেন্ট। সিংহাসনের দুই পাশে তাঁর বক্তব্য লিপিবদ্ধ করার জন্যে দুই জন লিপিকার বসে আছে।
মেরেনকে স্বীকৃতি দিলেন ফারাও নেফার সেতি। লর্ড মার্শাল, তোমাকে যে কাজ দিয়েছিলাম সেটা শেষ করতে পেরেছ?
পেরেছি, শক্তিমান ফারাও। আপনার শত্রু এখন আমার হেফাযতে।
তোমার কাছে এর চেয়ে কম কিছু আশা করিনি। তবুও অনেক খুশি হয়েছি। তাকে এবার আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্যে নিয়ে আসতে পারো।
মেঝের উপর বর্শার ফলা দিয়ে তিনবার আঘাত করল মেরেন। সাথে সাথে পেরেক লাগানো স্যান্ডেলের আওয়াজ উঠল মেঝেয়, দশজন প্রহরী সার বেঁধে কামরায় ঢুকল। ওদের সাথে থাকা বন্দিকে চেনার আগ পর্যন্ত শূন্য দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকালেন রানি মিনতাকা।
সোয়ে দিগম্বর, শাদা ব্রিচ ক্লাউট ছাড়া গায়ে কিছু নেই। কব্জি ও গোড়ালিতে বাঁধা রয়েছে ভারি ধাতব শেকল। চেহারা ভেঙে পড়েছে তার, কিন্ত মুখটা উদ্ধত ভঙ্গিতে উঁচু করে রেখেছে। ঢোক গিললেন মিনতাকা, এক লাফে উঠে মহা বিস্ময় ও ভয়ের সাথে তাকালেন ওর দিকে। ফারাও, উনি একজন শক্তিমান ও ক্ষমতাশালী পয়গম্বর; নামহীন দেবীর একজন ভৃত্য। উনি তো শত্রু নন! ওর সাথে। এমন আচরণ করতে পারি না আমরা।
ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকলেন ফারাও। সে আমার শত্রু না হলে তাকে আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছ কেন? জানতে চাইলেন তিনি।
থতমত খেয়ে গেলেন মিনতাকা, এক হাতে মুখ ঢাকলেন। সিংহাসনে মিশে গেলেন তিনি। চেহারা ছাইয়ের মতো ফ্যকাশে হয়ে গেছে, চোখজোড়া ভীত।
আবার সোয়ের দিকে ফিরলেন ফারাও। তোমার নাম বলো! বন্দিকে নির্দেশ দিলেন তিনি।
স্পর্ধিত দৃষ্টিতে তাকাল সোয়ে। আমি নামহীন দেবী ছাড়া আর কারও কর্তৃত্ব মানি না, ঘোষণা করল সে।
তুমি যার কথা বলছ এখন আর সে নামহীন নেই। তার নাম ছিল ইয়োস। কোনওদিনই দেবী ছিল না সে।
সাবধান! চিৎকার করে উঠল সোয়ে। আপনি ধর্মের অপমান করছেন। দেবীর অভিশাপ ক্ষিপ্র, নিশ্চিত।
তার বিস্ফোরণ উপেক্ষা করলেন ফারাও। তুমি এই জাদুকরীর সাথে নীল মাতার জলে বাঁধ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিলে?
আমি কেবল দেবীর কাছেই জবাবদিহি করি, খেঁকিয়ে উঠল সোয়ে।
জাদুকরীর সাথে যোগসাজশে তুমি মিশরের উপর প্লেগ ডেকে আনতে অতিলৌকিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়েছিলে? আমাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করাই কি তোমার মতলব ছিল?
আপনি সত্যিকারের রাজা নন! চিৎকার করে বলল সোয়ে। আপনি ক্ষমতা দখলকারী, ধর্মদ্রোহী! ইয়োসই পৃথিবী ও এর সকল জাতির আসল শাসক!
তুমি আমার বাচ্চাদের হত্যা করেছ, রাজকীয় রক্তের যুবরাজ আর রাজকন্যাকে?
ওরা রাজরক্তের ছিল না, নিশ্চিত সুরে বলল সোয়ে। ওরা সাধারণ লোক। কেবল দেবীই রাজ রক্ত ধারণ করেন।
তুমি আমার রানিকে সম্মানের পথ থেকে বিচ্যুত করতে তোমার অশুভ প্রভাব কাজে লাগিয়েছ? জাদুকরীকে ক্ষমতায় বসানোর জন্যে তোমাকে সাহায্য করতে ওকে বিশ্বাস করিয়েছ?
এটা আপনার সিংহাসন নয়। এটা ইয়োসের বৈধ সিংহাসন।
আমার রানির কাছে বাচ্চাদের আবার জীবিত করার কথা দিয়েছ? জানতে চাইলেন ফারাও। তলোয়ারের ফলার মতো শীতল, তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর।
কবর কখনও নিজের ফল খায় না, জবাব দিল সোয়ে।
তার মানে তুমি মিথ্যা বলেছ। দশ হাজার মিথ্যা! তুমি মিথ্যা বলেছ, খুন করেছ আর আমার সাম্রাজ্য জুড়ে অসন্তোষ ও হতাশার বিস্তার ঘটিয়েছ।
ইয়োসের সেবায় মিথ্যা হচ্ছে সৌন্দর্যের বিষয়, হত্যা মহান কাজ। আমি মোটেই অসন্তোষ ছড়াইনি, সত্যি কথা প্রচার করেছি।
সোয়ে, নিজের মুখের কথায়ই তোমার অপরাধ প্রমাণিত হয়ে যায়।
আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবেন না আপনি। আমার দেবী আমাকে রক্ষা করবেন।
ইয়োস ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমার দেবীর আর অস্তিত্ব নেই, গম্ভীর কণ্ঠে প্রকাশ করলেন ফারাও। মিনতাকার দিকে ফিরলেন তিনি। রানি আমার, যথেষ্ট শোনা হয়েছে?
নীরবে কাঁদছিলেন মিনতাকা। এমনই হতবিহ্বল হয়ে গেছেন যে মুখে কথাই সরছে না। তবে মাথা দোলালেন তিনি। লজ্জায় মুখ ঢাকলেন।
এইবার দরবারের একেবারে শেষ প্রান্তে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো অবয়বের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন তিনি। তাইতার শিরস্ত্রাণের ভাইজর নামানো। ফেনের মুখ পর্দায় ঢাকা। কেবল ওর সবুজ চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে।
ইয়োস কীভাবে ধ্বংস হলো বলো আমাদের, নির্দেশ দিলেন ফারাও।
শক্তিমান, আগুনে পুড়ে মারা গেছে সে, বলল তাইতা।
তাহলে তার চিড়িয়াও একই ভাগ্য বরণ করবে, এটাই তো মাননসই।
সেটা হবে অনেক আরামের মৃত্যু, তার যোগ্যতার চেয়ে ভালো। নিষ্পাপ লোকজনকে সে যেভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে তার চেয়ে অনেক ভালো।
চিন্তিতভাবে মাথা দোলালেন ফারাও। তারপর মিনতাকার দিকে ফিরলেন।
আমি তোমাকে আমার ও মিশরের দেবতাদের চোখে নিজেকে মুক্ত করার একটা সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছি।
ফারাওর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন মিনতাকা। কী করছি বুঝতে পারিনি। সে আমাকে কথা দিয়েছিল নীল আবার প্রবাহিত হবে, আমাদের বাচ্চারা আবার বেঁচে উঠবে, যদি আপনি দেবীকে মেনে নেন। আমি তার কথা বিশ্বাস করেছি।