আসকারতো! ইয়োসের মূর্তির দিকে তলোয়ার তাক করল তাইতা। আস্তে আস্তে সামনে উল্টে পড়তে শুরু করেছে ওটা।
সিলোন্দেলা! চিৎকার করে বলল ও। পথের পাথরের উপর সপাটে উল্টে পড়ল মূর্তিটা, অসংখ্য টুকরোয় ভাগ হয়ে গেল। কেবল নিখুঁত পাজোড়া অক্ষত রইল। সামনে এগিয়ে গেল তাইতা, তলোয়ারের ডগা দিয়ে প্রতিটি পা স্পর্শ করল। আস্তে আস্তে ফেটে চৌচির হয়ে গেল ওগুলো, গোলাপি ধুলোয় পরিণত হলো অবশেষে। প্রিন্থের উপরে রাখা সূর্য পদ্মের গোছা নেতিয়ে যেতে লাগল, এক সময় শুকিয়ে কালো হয়ে গেল।
ধীর পায়ে প্রিন্থের ভিত্তি ঘিরে একটা চক্কর দিল তাইতা। কয়েক কদম পর পর মার্বলের উপর টোকা দিচ্ছে। পেছনের দেয়ালের কাছে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত দৃঢ়, নিরেট শোনাল আওয়াজটা। তারপর ক্ষীণ, ফাঁপা একটা প্রতিধনি বিলোল মাৰ্বল পাথর। পিছিয়ে গিয়ে পরখ করল তাইতা। তারপর আবার সামনে বেড়ে হাতের গোড়া দিয়ে ওটার ডান কোণে চাপ দিল। ভেতরে কোনও লেভার নড়ে ওঠার তীক্ষ্ণ শব্দ হলো। ট্র্যাপডোরের মতো গোটা প্যানেলটা খুলে গেল।
পরবর্তী নীরবতায় ওরা প্রিন্থের পেছনে খুলে যাওয়া কালো চৌকো ফোকরটার দিকে তাকিয়ে রইল। একজন লোকের ঢোকার মতো যথেষ্ট বড় ওটা।
ইয়োসের মিথ্যে পয়গম্বরের আত্মগোপনের জায়গা, বলল তাইতা। দরবার হলের ব্র্যাকেট থেকে মশাল নিয়ে এসো। নির্দেশ পালন করতে দ্রুত ছুটে গেল প্রহরীরা। ওরা ফিরে এলে একটা মশাল নিয়ে খোলা মুখে ধরল তাইতা। মশালের আলোয় অন্ধকারে নেমে যাওয়া একটা সিঁড়ি দেখতে পেল ও। নির্দ্বিধায় সামনে ঝুঁকে ভেতের চোখ চালাল। মোট তেরটা সিঁড়ি, নিচে নেমে একজন দীর্ঘদেহী মানুষ না ঝুঁকেই হাঁটার মতো উঁচু একটা সুড়ঙে পরিণত হয়েছে। মেঝেটা সাধারণ স্যান্ডস্টোন টাইলসের। দেয়ালগুলো ছবি বা খোদাই কর্ম দিয়ে অলঙ্কৃত নয়।
আমার খুব কাছে থেকো, সড়ঙ দিয়ে দ্রুত এগোনোর সময় মেরেনকে বলল তাইতা। বাতাস, বাসী, ভারি; সঁতসেঁতে মাটি আর অনেক দিন আগে চাপা দেওয়া মৃত জিনিসের গন্ধে ভারি হয়ে আছে। দুবার সুড়ঙের মোড়ে হাজির হলো। তাইতা, কিন্তু চিন্তা করার জন্যে না থেমেই সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে পথ বেছে নিল ও। অবশেষে ওর সামনে আলোর একটা আভা দেখা গেল। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল ও।
একটা রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল ও, এখানে তেল, পানি আর মদের বিরাট বিরাট কলসী রাখা। ধুরা রুটির কাঠের ঝুড়ি আর ফল ও সজির ঝুড়ি রয়েছে। ছাদের হুক থেকে ঝুলছে পোড়ানো পা। কামরার ঠিক কেন্দ্রে অগ্নিকুণ্ডের ছাই থেকে ধোঁয়ার ক্ষীণ একটা রেখা সর্পিল গতিতে উঠে ছাদের ভেন্টিলেশন ফোকরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কাঠের টেবিলের উপর একটা জগ ও লাল মদের গামলাসহ অর্ধভুক্ত খাবার। একটা ছোেট তেলের কুপি আধো আলো বিলোচ্ছে চারপাশে। রান্নাঘর পেরিয়ে উল্টোদিকের দেয়ালের দরজার দিকে এগিয়ে গেল তাইতা। একটা সেলের দিকে নজর বোলাল, একটা মাত্র লণ্ঠনের আলোয় ম্লানভাবে আলোকিত হয়ে আছে ওটা।
কিছু পোশাক, টিউনিক, একটা জোব্বা ও এক জোড়া স্যান্ডেল অবহেলাভরে এক কোণে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। মেঝের মাঝখানে একটা মাদুর বিছানো, ওটার উপর শেয়ালের চামড়ার কারোস। কারোসের একটা কোণ ধরে একপাশে ছুঁড়ে ফেলল তাইতা। ছোট একটা বাচ্চা শুয়ে ওটার নিচে, দুই বছরের বেশি হবে না বয়স; মনকাড়া ছোট ছেলে, ওর চোখজোড়া বিরাট, কৌতূহলী, তাইতার দিকে। চোখ তুলে তাকাল সে।
হাত বাড়িয়ে ছেলেটার মাথা স্পর্শ করল তাইতা। হিসহিস একটা শব্দ হলো, পোড়া মাংসের কটু গন্ধ পাওয়া গেল। চিৎকার করে দুমড়ে মুচড়ে তাইতার কাছ থেকে সরে যাবার চেষ্টা করল বাচ্চাটা। ওর চাঁদির উপর কাঁচা লাল ছ্যাকার দাগ। পড়েছে। তাইতার হাতের আউটলাইন নয়, বরং ইয়োসের বেড়াল থাবার চিহ্ন।
ছোট্ট মানুষটাকে আঘাত করেছেন আপনি, বলে উঠল মেরেন, প্রায় কোমল ওর কণ্ঠস্বর।
ওটা কচি খোকা নয়, জবাব দিল তাইতা। এটা জাদুকরীর শেষ অশুভ ডালপালা। আবার ছেলেটাকে স্পর্শ করতে হাত বাড়াল ও। কিন্তু তীক্ষ্ণ চিৎকার ছেড়ে হাঁছড়েপাছড়ে সরে গেল সে। গোড়ালী ধরে উল্টো করে তাকে ঝোলাল তাইতা। ওর হাতের মুঠোয় পাক খাচ্ছে, যুঝছে ওটা। মুখোশ খোলো, সোয়ে। তোমার মালকিন ডাইনী জমিনের নিচের আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। ওর কোনও শক্তিই আর তোমার কাজে আসবে না। ছেলেটাকে মাদুরের উপর ছুঁড়ে ফেলল ও। ওখানে শুয়ে কুঁইকুই করতে লাগল সে।
ওর ওপর ডান হাতের একটা ইশারা করল তাইতা, সোয়ের ফাঁকি দূর করে দিল। আস্তে আস্তে গড়ন আর চেহারা পাল্টে ডাইনীর দূতের রূপ ধারণ করল ছেলেটা; চোখজোড়া জ্বলছে তার, ঘৃণা আর বৈরিতায় বিকৃত হয়ে গেছে চেহারা।
এখন চিনতে পারছ? মেরেনকে জিজ্ঞেস করল তাইতা।
সেথের মুখের দুর্গন্ধের কসম, এ যে দেখছি সোয়ে, দিমিতারের উপর কুনো ব্যাঙ লেলিয়ে দিয়েছিল। শয়তানের বাচ্চাটাকে শেষবার ওর মতোই এক হায়েনার পিঠে সওয়ার হয়ে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখেছিলাম।
ওকে বেঁধে ফেল, নির্দেশ দিল তাইতা। ফারাওর বিচারের মুখোমুখি হতে কারনাকে যাচ্ছে সে।
*
রাজ দম্পতির আসুইত থেকে কারনাকে ফিরে আসার পরদিন সকালে মিনতাকা মপ্রাসাদের খাস দরবার হলে ফারওর সাথে বসে আছেন। উঁচু জানালা গলে ঢুকে পড়েছে উজ্জ্বল সূর্যের আলো। কিন্তু সেটা তাঁকে আমোদ যোগাচ্ছে না। তাকে ক্লান্ত, পর্যদস্ত মনে হচ্ছে। মেরেনের মনে হচ্ছে মাত্র কয়েকদিন আগে ওকে (শেষবার দেখার পর অনেক বয়স বেড়ে গেছে তার।