ওদের সাথে তীরে নেমেছে তাইতা ও ফেন। এখনকার জীবনে প্রথমবারের মতো যে দেশ এক সময় শাসন করেছে ও, সেই দেশ দেখছে ফেন। মিশরের কেউই তাইতা বা ফেনকে ওদের এখনকার চেহারায় চিনবে না। তাই দীর্ঘ সময় ওদের আড়াল করে রাখা জাদুর মায়া তুলে নিল তাইতা। তবে নেকাবে চেহারা ঢেকে রাখল, যাতে কেবল ওদের চোখ দেখা যায়। তারপর জনতার ভিড়ে স্বাধীনভাবে মিশে গেল।
তাইতার মুখে চারপাশের সবকিছুর ব্যাখ্যা শুনতে গিয়ে ফেনের চোখ বিস্ময় আর আনন্দে ঝিলিক খেলছে। এতদিন অন্য জীবনের স্মৃতি ছিল আবছা, কাল্পনিক সেগুলো তাইতাই ওর মনে রোপন করেছিল। তবে এখন আপন দেশের মাটিতে দাঁড়ানোর পর সবকিছু ঝড়ের বেগে ফিরে এসেছে ওর মনে। শত বছর আগের চেহারা, কথা আর কর্মকাণ্ড মাত্র কয়েক বছর আগের ঘটনাপ্রবাহের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ওর মনে।
কোম কোম্বে মন্দির এলাকার বিশাল দেয়ালের নিচে নৌকা ভেড়াল ওরা। চুনাপাথরের চাঁইয়ের উপর দেব-দেবীদের বিশাল সব মূর্তি খোদাই করা। পর্যটকদের স্বাগত জানাতে প্রধান পুরোহিতিনী ও তার দলবল নদীর তলদেশে নেমে এলে ফেনকে নিয়ে হাথরের বিরান মন্দিরের করিডর ধরে ম্লান শীতল খাস মহলে নিয়ে চলল তাই।
এখানেই প্রথম এখনকার চেহারায় তোমার বিদেহী আত্মার দেখা পেয়েছিলাম, ওকে বলল তাইতা।
হ্যাঁ! ভালো করে মনে আছে সেটা, ফিসফিস করে বলল ফেন। এই জায়গার কথা পরিষ্কার মনে আছে। পবিত্র পুকুর হয়ে তোমার কাছে সঁতরে আসার কথা মনে করতে পারছি। আমাদের কথাগুলোও মনে আছে। যেন উচ্চারণ করার আগে মনে মনে মহড়া দিতে একটু থামল সে। আমাকে চিনতে পারছ না, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। কারণ আমি ফেন, মিষ্টি ছেলেমানুষি উচ্চারণে বলল সে, তাইতার হৃদয়ে অনুরণন তুলল সেটা।
ঠিক এই সুরেই কথাটা বলেছিলে, বলল তাইতা।
তুমি কী জবাব দিয়েছিলে মনে আছে? মাথা নাড়ল তাইতা। পরিষ্কার মনে আছে ওর, কিন্তু ফেনের মুখে শুনতে চাইছে।
তুমি বলেছ… ওকে নকল করতে কণ্ঠস্বর পাল্টে ফেলল ও। আগাগোড়াই তোমাকে চিনেছি আমি। তোমার সাথে প্রথম পরিচয়ের সময় যেমন ছিলে ঠিক তেমনই আছো। তোমার ওই চোখের কথা কোনও দিন ভুলতে পারব না। তখনকার মতো এখনও সারা মিশরের সবচেয়ে সবুজ আর সুন্দর চোখ ওগুলো।
মৃদু হাসল তাইতা। মেয়ে মানুষ আর কাকে বলে! কোনওদিন প্রশংসার কথা ভোলো না।
নিশ্চয়ই এমন চমৎকার প্রশংসা নয়, সায় দিল ফেন। তোমার জন্যে একটা উপহার নিয়ে এসেছিলাম আমি। কী ছিল সেটা মনে করতে পারো?
একমুঠো চুনো পাথরের গুঁড়ো, চট করে জবাব দিল ও। অমূল্য উপহার।
এখন দাম মেটাতে পারো। একটা চুমু দিলেই চলবে, বলল ফেন। কিংবা তোমার যতগুলো মনে চায়।
আমার মনে দশ হাজার সংখ্যাটা জেগে উঠেছে।
তোমার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি। এখুনি প্রথম একশোটা নেব আমি। বাকিগুলো কিস্তিতে শোধ করতে পারো।
*
ওরা যত কারনাকের কাছাকাছি আসছে ততই ওদের চলার গতি ধীর হয়ে আসছে। আনন্দমুখর জনসাধারণের বাধার মুখে পড়ছে ওরা। অবশেষে রাজকীয় বার্তাবাহক ফারাওর প্রাসাদ থেকে উজানের বেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে হাজির হলো। নৌবহরের অধিনায়কের কাছে নির্দেশ নিয়ে এসেছে, দ্রুততার সাথে কারনাকের দরবারে উপস্থিত হতে হবে।
তোমার নাতী নেফার সেতি ধৈর্য ধরতে শেখেননি, ফেনকে বলল তাইতাকা, শুনে উত্তেজিতভাবে হেসে উঠল ও।
ওকে দেখতে আর কতদিন লাগবে! মেরেনকে জলদি ফেরার নির্দেশ দিয়েছে শুনে আমি খুশি হয়েছি। এখন নেফার সেতির বয়স কত হতে পারে?
সম্ভবত চুয়ান্ন বছর আর ওর রানি ও প্রধান স্ত্রী মিনতাকাও তেমন তরুণী নেই। তার সম্পর্কে তোমার কী ধারণা হয় দেখাটা মজাদার হবে, কারণ চরিত্রের দিক থেকে তিনি অনেকটা তোমার মতোই। বুনো, বদমেজাজি। ক্ষেপে উঠলে তোমার মতোই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন।
বুঝতে পারছি না, কথাটা প্রশংসা করে বললে নাকি এটা কোনও রকম অপমান, জবাব দিল ফেন। তবে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত, ওকে আমার পছন্দ হবে, আমার নাতীপুতিদের মা।
আমার ধারণা তিনি বিপদে আছেন। এখনও ইয়োস আর ভুয়া পয়গম্বর সোয়ের প্যাঁচে পড়ে আছেন তিনি। ইয়োস মরে গেছে, তার সব ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু সোয়ে এখনও তাঁকে বন্দি করে রেখেছে। ওকে মুক্ত কারাই হবে আমাদের শেষ পবিত্র দায়িত্ব। এরপর তুমি আর আমি আমাদের নিজেদের স্বপ্নের পিছু নেব।
তো কারনাকে পৌঁছুল ওরা, শত দুয়ার আর অপরিমেয় বিস্ময়ের নগরী, প্রবহমান জলের কল্যাণে সবই আবার ফিরে এসেছে। এখানকার জনতা ওদের সাথে দেখা হওয়া অন্য যেকোনও জায়গার জনতার তুলনায় আরও নিবিড় ও উল্লাসমুখর। নগরীর তোরণ গলে স্রোতের মতো বের হয়ে এলো ওরা, ঢোল, শিংগা আর চিৎকারের অওয়াজ বাতাসে কাঁপন তুলল।
রাজকীয় বন্দরে দাঁড়ানো ছিল সরকারী পোশাক পরা পুরোহিত, অভিজাতজন ও জেনারেলদের এক অভ্যর্থনা কমিটি, ওদের সাথে অন্যান্য সঙ্গীরাও একই রকম জকাল পোশাক পরেছে।
মেরেন ও তিনাত তীরে নেমে আসতেই সুরেলা উৎসবমুখর সুর ধ্বনিত হলো শিংগায়। জনতার মাঝে প্রশংসার দারুণ সাড়া পড়ে গেল। প্রধান উযির পথ দেখিয়ে ওদের জন্যে তৈরি করে রাখা দুটো জাঁকালভাবে সাজানো রথের কাছে নিয়ে গেলেন। দুটো বাহনই সোনা ও মূল্যবান পাথরে ঢাকা, ফলে উজ্জ্বল রোদে ঝিলিক মারছে। ফারাওর নিজস্ব আস্তাবলের নিখুঁতভাবে মানানসই ঘোড়ার দল টানছে ওগুলোকে। একটা দুধ শাদা, অন্যটা সেগুন কাঠের মতো কালো।