মেরেনের চেহারা গম্ভীর। খানিকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল সে, যেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তারপর লম্বা করে দম নিল। ম্যাগাস আর আমাদের সাথে নেই, এই কথাটা বলার জন্যে আজকের দিনটা আমার জন্যে খুবই বেদনাদায়ক ও কষ্টকর। রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছেন তিনি। আমি আর কর্নেল তিনাত তাঁর অন্তর্ধানের জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। আবার থামল সে, তারপর মাথা নাড়ল। লাশ খুঁজে না পেলেও আমরা তার কাপড় আর ঘোড়ার সন্ধান পেয়েছি তার টিউনিক রক্তে মাখামাখি ছিল, স্যাডলও। আমরা তাঁর অন্তর্ধানের জন্যে কেবল কোনও রহস্যময় অতিপ্রাকৃত ঘটনাকেই দায়ী করতে পারি। ধরে নিতে পারি ম্যাগাস মারা গেছেন।
শোকের একটা গোঙানি তার কথাগুলোকে স্বাগত জানাল।
নীরবে বসে রইলেন গভর্নর নারা, চেহারা ফ্যাকাশে, বিষণ্ণ। অবশেষে হলের অওয়াজ কমে এলে তার দিকে তাকাল সবাই। উঠে কথা বলতে শুরু করলেন, কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর বুজে এলো। নিজেকে সামলে নিয়ে তারপর শুরু করলেন তিনি।
দুঃখের সংবাদ। গালালার তাইতা ছিলেন শক্তিশালী ও ভালো মানুষ। ভারাক্রান্ত মনে ফারাও নেফার সেতির কাছে আমি তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছে দেব। কেবুই নোমের গভর্নর হিসাবে আমার ক্ষমতানুযায়ী নদীর তীরে নীল মাতার জীবনদায়ী জলেরপ্রবাহ আবার ফিরিয়ে আনায় গালালার তাইতার সম্মানে একটা সৌধ নির্মাণের নির্দেশ দেব। আরও কিছু বলতে চাইলেন তিনি, কিন্তু মাথা নেড়ে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি ভোজের কামরা ছেড়ে যাবার সময় অতিথিরা অনুসরণ করল তাকে। রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি।
পাঁচদিন পর শহরের অধিবাসী ও দক্ষিণ থেকে আগত অভিযাত্রীরা আবার নীলের দুটি শাখার সঙ্গম স্থলে দাঁড়ানো এক চিলতে জমিনে মিলিত হলো। গভর্নর নারা নির্মিত সৌধটা একটা মাত্র নীল গ্রানিট কুঁদে বের করা একটা স্তম্ভ। ওটার গায়ে খোদাই করা হয়েছে অসাধারণ নকশার হিরিওগ্রাফিক হরফে একটা লিপি। আজকের দিনের জন্যে ওটাকে তৈরি করতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছে রাজমিস্ত্রিরা:
ফারাও নেফার সেতির নামে দুই রাজ্যে তার শাসনামলের ছাব্বিশতম বছরে এই স্তম্ভটি স্থাপন করা হলো, তিনি যেন চিরন্তন জীবন লাভ করেন।
এই স্থান হতে ম্যাগাস গালালার তাইতা নীল মাতার উৎস মুখ আবিষ্কারের লক্ষ্যে তাঁর ঐতিহাসিক অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন, মিশরিয় সাম্রাজ্য এবং এর সকল নাগরিকের কল্যাণে আশির্বাদপ্রাপ্ত নদীর প্রবাহ আবার উন্মুক্ত করে তোলার জন্যে।
তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি বলে এই বিপজ্জনক অভিযানে সাফল্য অর্জন করেছেন। তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা যেন অব্যাহত থাকে!
দুঃখজনকভাবে গহীন বনে তিনি তিরোহিত হয়েছেন। আর কোনওদিন আমাদের প্রাণপ্রিয় মিশরে না ফিরলেও তাঁর স্মৃতি ও তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা এই গ্রানিট স্তম্ভের মতোই দুই হাজার বছর টিকে থাকবে।
আমি নোম কেবুইয়ের গভর্নর নারা, দেবতাদের প্রথম পছন্দ ফারাও নেফার সেতির নামে তার প্রশংসায় এই কথাগুলো উত্তীর্ণ করছি।
সকালের রোদের আলোয় গ্রানিট স্তম্ভের চারপাশের জমায়েত হোরাস ও হাথরের উদ্দেশ্যে প্রশংসা সঙ্গীত গাইল, তাইতার বিদেহী আত্মাকে নিরাপদে তুলে নেওয়ার আবেদন জানাল তারা। তারপর দলবল নিয়ে অপেক্ষমান নৌকার উদ্দেশে রওয়ানা হলো মেরেন ও তিনাত। নৌকায় উঠে প্রত্যাবর্তনের শেষ পর্যায়ে ফের ওদের যাত্রা শুরু করল। ছয়টা বিশাল জলপ্রপাতের ভেতর দিয়ে আরও দুই হাজার লীগ দূরত্ব, তারপর মিশরের উর্বর ভূমি।
নীলের জল ফুলে ফেঁপে ওঠায় জলপ্রপাতগুলো এখন ভীষণ পানির দীর্ঘ শাদা সুড়ঙে পরিণত হয়েছে। তবে জাররিয় নৌকাগুলো ঠিক এই রকম পরিস্থিতির কথা ভেবেই বানানো হয়েছিল। আর মেরেও দক্ষ নদীর চালক। ভুল করলেই ওকে ঠিক পথ দেখাতে ঠিক ওর কনুইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে অদৃশ্য তাইতা। ওরা দুজনে মিলে তেমন মারাত্মক কোনও ক্ষতি ছাড়াই নৌবহর পার করে আনল।
পঞ্চম ও দ্বিতীয় জলপ্রপাতের মাঝখানে নদীটা বিশাল একটা বাঁক নিয়ে পশ্চিমের মরুভূমিতে মিলে যাওয়ায় যাত্রা পথে বাড়তি এক হাজার লীগ দূরত্ব যোগ হয়েছে। গভর্নর নারার পাঠানো রিলে রাইডাররা ওদের চেয়ে পাঁচ দিন এগিয়ে ছিল; ওরা জমিনের উপর দিয়ে চলে যাওয়া কাফেলার চলার পথ ধরে নদীর উপর দিয়ে সরাসরি পেরিয়ে যেতে পেরেছে। ওদের নিয়ে আসা সংবাদ আসৌন নোমের গভর্নর নৌবহর প্রথম জলপ্রপাত হয়ে মিশরের উপত্যকায় নেমে আসার অনেক আগেই পড়ে ফেলেছিলেন। এইখান থেকে অভিযান এক বিজয়ী প্রক্রিয়ায় পরিণত হলো।
নদীর দুপাশেই জমিন জীবনদায়ী জলে প্লাবিত হয়ে আছে। কৃষকরা ক্ষেতে খামারে কাজ করার জন্যে গ্রামে ফিরে এসেছে। এরই মধ্যে সবুজ, প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে ওদের ফসল। নৌকাগুলো পাশ কাটিয়ে যাবার সময় সাধারণ জনগণ ছুটে এলো পাড়ে, তালপাতার শাখা দোলাচ্ছে; জলের ভেতর জেসমিন ফুলের তোড়া ছুঁড়ে ফেলল ওরা, ফ্লোটিলার সাথে ভেসে চলল ওগুলো। আনন্দে কাঁদছে ওরা, পৃথিবীর দক্ষিণের বিস্তারের রহস্যময় অন্ধকার থেকে ফিরে আসা বীরদের উদ্দেশে প্রশংসার বাণী উচ্চারণ করছে।
প্রতিটি শহর পর্যটকদের কাছে আসার সাথে সাথে সেখানকার গভর্নর, অভিজাতজন ও পুরোহিতরা মিছিল করে মন্দিরে নিয়ে যাচ্ছে ওদের, ভোজে আপ্যায়িত করছে, ফুলের পাপড়ির বৃষ্টি ঝরানো হচ্ছে ওদের উপর।